চট্টগ্রাম নগরে শব্দ নিয়ন্ত্রণহীন, নীরব এলাকায়ও দূষণ

নগরের ৩০টি স্থানের সব কটিতে শব্দ মাত্রাতিরিক্ত। শিশুদের হৃদ্‌রোগ এবং শ্রবণহীনতার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

শব্দদূষণপ্রতীকী ছবি

চট্টগ্রাম নগরের জামালখান মোড়ে তিনটি বিদ্যালয় ও দুটি উপাসনালয় রয়েছে। মোড়ের ১০০ গজের মধ্যে আরও দুটি বিদ্যালয়ের অবস্থান। নীরব এলাকা হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তর ওই মোড়ে একটি সাইনবোর্ডও দিয়েছে। তবে নির্দেশনা মেনে চলার কোনো বালাই নেই। যানবাহনের হর্ন কিংবা মাইকের শব্দ নিত্যদিন শুনতে হচ্ছে ওই এলাকার বাসিন্দাদের।

নগরে এ রকম ১৫টি নীরব এলাকার অবস্থাও এমন। এসব এলাকার শব্দের মানমাত্রা নিয়মিত যাচাই করে পরিবেশ অধিদপ্তর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, নীরব এলাকার গ্রহণযোগ্য মান ৪৫ ডেসিবেল। কিন্তু কোনো নীরব এলাকা এই মানে থাকছে না। শব্দদূষণ হচ্ছে এসব এলাকায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, নগরের প্রতিটি নীরব এলাকায় শব্দের মান ৬০ থেকে ৭৪ ডেসিবেল।

বাংলাদেশ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, নীরব এলাকার শব্দের মানমাত্রা ৫০ ডেসিবেল। তবে এই মানেও রাখা যাচ্ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল–সংলগ্ন নীরব এলাকাকে। একইভাবে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও মিশ্র এলাকার শব্দের মানমাত্রাও মাত্রাতিরিক্ত। চট্টগ্রাম নগরের ৩০টি স্থানের সব কটিতে শব্দ মাত্রাতিরিক্ত। শব্দদূষণের কারণে শিশুদের হৃদ্‌রোগ ও শ্রবণহীনতার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

হাইড্রোলিক হর্নের যথেচ্ছ ব্যবহার, যত্রতত্র মাইক বাজানো, নির্মাণকাজ ও জেনারেটরের শব্দের কারণে এই দূষণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৭ সালে আটটি বিভাগীয় শব্দের মাত্রা পরিমাপবিষয়ক এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, চট্টগ্রামে ৯৫ ভাগ শব্দদূষণের মূল উৎস গাড়ির হর্ন। কিন্তু গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নের বিরুদ্ধে সে অর্থে জোরালো কোনো অভিযান নেই বললেই চলে। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ ও ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগারের পরিচালক নাসিম ফারহানা বলেন, ‘নগরের ৩০টি স্থানের শব্দের মানমাত্রা পরীক্ষা করি। বেশির ভাগ এলাকায় মানমাত্রা সহনীয় অপেক্ষা বেশি। নীরব এলাকাগুলোতে আমরা সাইনবোর্ড টাঙিয়েছি। এ ছাড়া অভিযানও পরিচালনা করা হয়।’

শব্দের মানমাত্রা গ্রহণযোগ্য মানের চেয়ে বেশি

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম শহরের ৩০টি স্থানে প্রতি মাসের বিভিন্ন দিনে শব্দের মানমাত্রা পরীক্ষা করে থাকে। এ বছরের জানুয়ারি, মে, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের পরীক্ষা থেকে দেখা যায়, প্রতিটি এলাকায় শব্দের মান গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি রয়েছে। বাণিজ্যিক এলাকা অক্সিজেন মোড়ে নভেম্বর মাসে শব্দ পাওয়া গেছে ৮২ ডেসিবেল। একইভাবে জিইসি মোড়ে একই মাসে  ছিল ৭৫ ডেসিবেল। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এলাকা নীরব হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এখানে পাওয়া যায় ৭০ ডেসিবেল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ৭৩ ডেসিবেল পাওয়া যায়।

অভিযান কম

জরিপ অনুযায়ী, শব্দদূষণের জন্য গাড়ির হর্ন, কলকারখানার শব্দ, নির্মাণকাজ, মিছিল, সভা–সমাবেশ, জেনারেটর ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়। শব্দের মাত্রা পরিমাপের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের ৪১টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করা হয়। ফলাফল অনুযায়ী, প্রতিটি স্থানে শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ ছিল। চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে নির্বাচিত স্থানগুলোর মধ্যে ইপিজেডে (ফ্রি পোর্ট মোড়) সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ ছিল। এসব এলাকায় এখনো একইভাবে শব্দদূষণ হচ্ছে।

হর্ন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বহদ্দারহাট, অক্সিজেন মোড়ে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বেশি।  বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিএ) হিসাবে, চট্টগ্রাম শহর এলাকায় গত নভেম্বর মাসে মাত্র ৬টি হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করেছে।

বিআরটিএর চট্টগ্রামের উপপরিচালক সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। তবে মাঝখানে কয়েক মাস ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন না। তাই একটু কম হয়েছে অভিযান।

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মিটন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি লোপ পেতে পারে। অস্থায়ী ও স্থায়ী—দুইভাবে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। একই কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। যাঁরা কারখানায় কাজ করেন কিংবা নির্মাণসামগ্রী ভাঙার কাজে জড়িত, তাঁদের শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতির মুখে পড়ে।