তুরাগ নদ
দূষণের ৯৬টি উৎস চিহ্নিত
উৎসগুলোর মধ্যে শিল্পকারখানার ১৭টি, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৮, খামারের ১২, হাটবাজারের ৬, সংযুক্ত নদী-খাল ৩, বসতবাড়ি ও অন্যান্য ৫০টি।
শিল্পকারখানার তরল বিষাক্ত বর্জ্যে দিন দিন বিষিয়ে উঠছে গাজীপুরের তুরাগ নদ ও খাল-বিল। পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ তুরাগের। পানি হয়ে উঠেছে কুচকুচে কালো। গাজীপুরের টঙ্গী থেকে মহানগরীর কড্ডা পর্যন্ত তুরাগ নদের ৪০ কিলোমিটার দূষণের জন্য ৯৬টি স্থানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থান দিয়ে কলকারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য তুরাগ নদে গিয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের যৌথ উদ্যোগে টঙ্গী নদীবন্দর থেকে কড্ডা এলাকা পর্যন্ত তুরাগ নদ পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করা হয়। টঙ্গীর আরিচপুর থেকে শুরু করে মাছিমপুর, টঙ্গী বাজার, কামারপাড়া, রুস্তমপুর, ইছরকান্দি, কাশিমপুর হয়ে কড্ডা বাজারে গিয়ে এ পরিদর্শন শেষ হয়।
পরিদর্শনে যা দেখলাম, তাতে তুরাগের শেষকৃত্য হয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
পরিদর্শনের বিষয়ে প্রতিনিধিদলের প্রধান বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেন জানান, তাঁরা মোট ৯৬টি দূষণ উৎস চিহ্নিত করতে পেরেছেন। উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে শিল্পকারখানার ১৭টি, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৮, খামারের ১২, হাটবাজারের ৬, সংযুক্ত নদী–খাল ৩, বসতবাড়ি ও অন্যান্য ৫০টি।
পরিদর্শন দলে থাকা অন্য সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাবিবুর রহমান, সহসভাপতি তাজুল ইসলাম, গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হোসাইন, সংবাদিক ও পরিবেশকর্মী আমিনুল ইসলাম, নদীকর্মী মনির হোসেন সরকার, রবিউল ইসলাম, নজরুল করিম, আমজাদ হোসেন, জন পল প্রমুখ।
বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পরিদর্শনে যা দেখলাম, তাতে তুরাগের শেষকৃত্য হয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’ সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী আমিনুল ইসলাম বলেন, জীবন্ত সত্তা তুরাগের প্রাণবায়ু বের হয়ে যাচ্ছে। তুরাগের আইনি অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে আর বাঁচানো যাবে না।
পরিদর্শক দলের ভাষ্য, শিল্পকারখানাগুলোয় ইটিপি থাকলেও ব্যবহার করা হয় না। টঙ্গী ও কোনাবাড়ী বিসিকসহ গাজীপুরে পাঁচ হাজারের বেশি কলকারখানা রয়েছে। এসবের তরল বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় ডোবায়। অনবরত দুর্গন্ধযুক্ত বর্জ্য পানি গিয়ে পড়ছে পাশের জলাশয়ে। সবশেষ ঠিকানা তুরাগ নদ। দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় অনেক নামি ও প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের তেমন তৎপরতা নেই। ফসলের মাধ্যমে তরল বিষ মানবদেহে ঢুকছে। জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
তুরাগ নদের আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা জানান, বর্জ্যমিশ্রিত পানির দুর্গন্ধে তাঁরা অতিষ্ঠ। খেতের ফসল, বিলের মাছ ধ্বংস হচ্ছে। উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে মাটি। কড্ডা এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, কারখানার মালিকদের আগ্রাসনে খালের পানি আলকাতরার মতো ভারী হয়ে উঠেছে। পানি লাগলে শরীর চুলকায়, ঘা হয়ে যায়। দুর্গন্ধে শিশু ও বৃদ্ধদের পেটের পীড়া লেগেই থাকে। বিষাক্ত পানি সরাসরি কৃষিজমি ও জলাশয়ে ছেড়ে দিয়ে এলাকার পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে।
গাজীপুর মহানগরীর কড্ডা, জরুন ও ইসলামপুর, হোতাপাড়া, মাস্টারবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানার তরল বর্জ্য রেলওয়ের ডোবায় গিয়ে মিশছে। সেখান থেকে কৃষিজমি, নালা ও পাশের জলাশয়, নাগদা খাল হয়ে কয়লার মতো কালো পানি গিয়ে মিশছে তুরাগ নদে। দূষিত ওই পানি দিয়ে বোরো জমিতে সেচ দিচ্ছেন কৃষকেরা। পানি থেকে উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, গাজীপুরে কয়েকটি ছাড়া সব কারখানায় বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) আছে, কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান ইটিপি চালু রাখে না। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। জরিমানা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১২টি প্রতিষ্ঠানের গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেন বলেন, গাজীপুরের পানিতে লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নদী-খাল-বিল ও জলাশয়ে দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। এক জলাশয় আরেক জলাশয়ের পানি দূষিত করছে। ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করছে। এতে মানবদেহ ও জলচর প্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ অঞ্চলের মানুষের চর্মরোগ, ব্রঙ্কাইটিস ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতির জন্য কারখানাগুলোয় ইটিপি স্থাপন ও নিয়মিত চালু রাখা নিশ্চিত করতে হবে। দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দূষণে গাজীপুর সংকটাপন্ন হলে রাজধানী ঢাকাকেও বাঁচনো যাবে না। কারণ, গাজীপুর হচ্ছে ঢাকার উজানের অঞ্চল।