অবৈধ সুবিধা নিতে না পেরে সেই শরীফ মামলা করেছিলেন, অভিযোগ ৩ আসামির
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাঁরই করা দুর্নীতির মামলার তিন আসামি।
আজ বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলন হয়। সংবাদ সম্মেলন করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. সারওয়ার হোসেন, একই প্রতিষ্ঠানের সার্ভেয়ার দিদারুল আলম ও আরএফ বিল্ডার্সের মালিক দেলোয়ার হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, অবৈধ সুবিধা নিতে না পেরে দুদকের তৎকালীন কর্মকর্তা শরীফ তাঁদের (সারওয়ার, দিদারুল ও দেলোয়ার) বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।
সারওয়ার, দিদারুল ও দেলোয়ারের করা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শরীফ। তিনি বলেছেন, দুর্নীতির সঙ্গে আপস করেননি বলেই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এখন তাঁরা জামিনে রয়েছেন। মামলা তদন্ত করছে দুদক।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সারওয়ার। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে শরীফ তাঁর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করেন। নিয়ম মেনে তিনি নগরের হালিশহর থেকে চান্দগাঁওয়ে ১২টি গ্যাসের চুলার সংযোগ স্থানান্তর করেছেন। শরীফের শাশুড়ির আকবর শাহ এলাকার গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ ছাড়া শরীফ তাঁর ভাই শিহাব উদ্দিনকে কেডিসিএলে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে অস্থায়ী নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। শিহাবের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার সনদ ছিল ভুয়া। শিহাবের চাকরি স্থায়ী করার জন্য কেডিসিএলের কর্মকর্তাদের চাপ দিতেন শরীফ। তিনি তাঁর এক খালাতো ভাইকে কেজিডিসিএলে গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। কক্সবাজারের বেলায়েত হোসেন নামের এক দালালের মাধ্যমে শরীফ ঘুষ নিতেন। শরীফের সম্পদ যাচাই-বাছাই করলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।
অভিযোগের বিষয়ে শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, হালিশহরের নুর জাহান নামের এক নারীর সই জাল করে তাঁর ১২টি চুলা চান্দগাঁওয়ে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলের নামে স্থানান্তর করেন সরোয়ার। নিয়ম অনুযায়ী, একই ব্যক্তি তাঁর নামে থাকা চুলা অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে পারবেন। কিন্তু তা অন্য ব্যক্তিকে হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে গত বছরের জুনে সরোয়ার, কেজিডিসিএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, ট্রান্সমিশন বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলম ও গ্রাহক মুজিবুর রহমানকে আসামি করে মামলা হয়। অনুসন্ধানে সত্যতা মেলায় দুদক অনুমোদন দেওয়ায় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। এখানে ব্যক্তিগত আক্রোশের কিছুই নেই।
শরীফ আরও বলেন, তাঁর কী সম্পদ আছে, তা কর্তৃপক্ষ তদন্ত করতে পারে। দুর্নীতি করলে আজকে তাঁকে দোকানের কর্মী হিসেবে চাকরি করতে হতো না।
এক ব্যক্তির নামের গ্যাসের চুলা কীভাবে অন্য ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা হলো, সে বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সরোয়ারের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
ভাই শিহাবের শিক্ষাগত যোগ্যতার সব কাগজপত্র সঠিক বলে দাবি করেন শরীফ। তিনি বলেন, সম্প্রতি চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাঁর ভাই পোষ্য কোটায় রেলওয়েতে যোগদানের অপেক্ষায় রয়েছেন। আর তাঁর কোনো খালাতো ভাই গাড়িচালক হিসেবে কেজিডিসিএলে নেই।
আকবর শাহ এলাকায় শাশুড়ির বাড়িতে গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন শরীফ।
জনৈক বেলায়েতের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন শরীফ। তিনি বলেন, তিনি বেলায়েতকে কক্সবাজারের পিবিআই প্রকল্পের দুর্নীতির মামলায় আসামি করার প্রস্তাব করেছেন। তাঁর মাধ্যমে তিনি যদি ঘুষ নিতেন, তাহলে তাঁকে কেন আসামি করার প্রস্তাব করলেন।
সংবাদ সম্মেলনে দেলোয়ার বলেন, তিনি বৈধ পথে আয় করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। তারপরও স্ত্রীসহ তাঁকে আসামি করে মামলা করেছেন শরীফ। নগরের ২ নম্বর গেট এলাকার দুটি দোকান তাঁর কাছে চেয়েছিলেন শরীফ। তা না দেওয়ায় শরীফ মামলা করেছেন।
দেলোয়ারের অভিযোগ অস্বীকার করেন শরীফ। তিনি বলেন, কমিশনের অনুমোদনের আলোকেই তিনি মামলা করার দায়িত্ব পান।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আসামিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে দুদক তা অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পেলে মামলার অনুমোদন দেয় সংস্থাটি। তাই শরীফের বিরুদ্ধে এখন কেন সংবাদ সম্মেলন করা হচ্ছে?
জবাবে আসামিরা বলেন, শরীফই সব করেছেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে এখন সংবাদ সম্মেলন করছেন তাঁরা।
দুদকের উপসহকারী পরিচালক ছিলেন শরীফ। দীর্ঘ সময় তিনি চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। তিনি কক্সবাজারে ৭২টি প্রকল্পে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, কিছু রোহিঙ্গার এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি মামলা করেন।
গত বছরের ১৬ জুন শরীফকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরিচ্যুতির কোনো কারণ উল্লেখ করেনি কর্তৃপক্ষ। তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই আদেশ প্রত্যাহারপূর্বক চাকরিতে পুনর্বহালের আবেদন করেন। তবে তাঁর আবেদন কমিশনের কাছে বিবেচিত হয়নি।
চাকরি হারিয়ে পরিবার নিয়ে সংকটে পড়েন শরীফ। দেড় মাস ধরে চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের পাশে বড় ভাইয়ের একটি কনফেকশনারি দোকানে চাকরি করছিলেন তিনি। এ নিয়ে ৭ নভেম্বর ‘দুদকের সাবেক কর্মকর্তা শরীফ এখন দোকানের কর্মী’ শিরোনামে প্রথম আলো অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁকে ফোন করে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়। কয়েক দিনের মধ্যে একটি কোম্পানিতে ৮০ হাজার টাকা বেতনে তাঁর যোগদান করার কথা। তবে শরীফ দুদকের চাকরি ফিরে পেতে চান। শরীফকে দুদকের চাকরিতে পুনর্বহাল চেয়ে এক আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেছেন। এখনো সেটির শুনানি হয়নি।
সাড়ে সাত বছরের চাকরিজীবনের প্রথম ছয় বছরই বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) শরীফকে দুদকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ‘অতি উত্তম’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁকে তদন্তকাজে ‘অভিজ্ঞ’ এবং ‘উদ্যমী ও দক্ষ কর্মকর্তা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে দুদক।