কালজয়ী এক পুরুষ

শাহ আবদুল করিমফাইল ছবি

শাহ আবদুল করিম। তাঁর নামের আগে-পরে বিশেষণ যুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলা ভাষাভাষীর কাছে এক নামেই তিনি পরিচিত। তাঁর লেখা গান শোনেননি, এমন মানুষ আজকাল কমই পাওয়া যাবে! চল্লিশের দশকেই ছিলেন হাওরাঞ্চলে বিপুলভাবে জনপ্রিয় এক শিল্পী। টানা সাত দশক ঐতিহ্যবাহী কেচ্ছা, মালজোড়া ও বাউল গানকে প্রাণবান করে রেখেছেন।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধলআশ্রম গ্রামে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন করিম। টাকাপয়সার অভাবে পড়াশোনা হয়নি। অল্প বয়সেই গ্রামের মহাজন বাড়িতে গরু চরানোর চাকরি নেন। ছিলেন মুদিদোকানের কর্মচারীও। সে সময় গানের জগতে ঢোকেন। বয়স ২০ পেরোনোর আগেই হয়ে ওঠেন সুপরিচিত শিল্পী। পরিণত বয়সে তাঁর ভরাট কণ্ঠের বাউলা আর মালজোড়া গান শুনে হাজারো মানুষের আসর জমে উঠত।

২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর আগেই ‘একুশে পদক’, ‘মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা’য় ভূষিত হন শাহ আবদুল করিম। করিম-রচিত প্রায় ৫০০ গানের অন্তত ১০০ গান তাঁর জীবদ্দশাতেই মানুষের মুখে মুখে ফিরত। এখন তা আরও বেড়েছে।

১৯৯৭ সালে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত ‘জলসা ঘর’ অনুষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এ অনুষ্ঠানে অভিনেতা আবুল খায়েরের নেওয়া শাহ আবদুল করিমের একটি সাক্ষাৎকারসহ তাঁর লেখা গান পরিবেশন করেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পীরা। অনুষ্ঠানটি শাহ আবদুল করিমকে নাগরিক মহলে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছিল।

যতই দিন যাচ্ছে, করিমের গান ততই চিরকালীন হয়ে উঠছে। দেশ-বিদেশে টিভি কিংবা এফএম রেডিওতে নিয়মিত বেজে চলে করিমের গান। নাগরিক ‘ভদ্রজনের’ বাসার ড্রয়িংরুম কিংবা ফুটপাতে চায়ের টংয়ে—সর্বত্র তাঁর গান সমানভাবে উপস্থিত। তাঁর জীবন ও কর্মভিত্তিক বইও লেখা হয়েছে বিস্তর। বাংলাদেশ-কলকাতার কয়েক শ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী গেয়েছেন তাঁর গান। ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাঁর গান কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন ভিনদেশি শিল্পীরাও।

শাহ আবদুল করিমের প্রকাশিত বই সাতটি। এগুলো হচ্ছে : আফতাব সঙ্গীত, গণসঙ্গীত, কালনীর ঢেউ, ধলমেলা, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে এবং শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র। বর্তমানে পয়লা বৈশাখ নববর্ষের আয়োজন যেমন ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ ছাড়া জমে না, তেমনই বসন্তের প্রথম দিনে গীত হয় করিম-প্রণীত ‘বসন্ত বাতাসে ও সই গো বসন্ত বাতাসে’। করিমের এ রকম অসংখ্য গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

গ্রামীণ বাংলার বৃহত্তর সমাজ ও মানুষের উপযোগী করে সাদাসিধে আটপৌরে ভাষায় গান রচনার পাশাপাশি শাহ আবদুল করিম দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে হাওরাঞ্চলের মানুষের চেতনাকে গান গেয়ে জাগ্রত করেছিলেন। সাধনপথের পথিক হয়েও করিম অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তচেতনার পাশাপাশি আগাগোড়াই ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন। তাই তিনি ‘গণমানুষের শিল্পী’ হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিলেন।

শাহ আবদুল করিম জীবদ্দশায় ছিলেন সব ধরনের লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। খ্যাতি, মোহ তাঁকে টানেনি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও টাকার পেছনে কখনো ছোটেননি। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে গণজাগরণের গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। জাতির যেকোনো দুর্যোগ-সংকটে উদ্দীপনামূলক গান গেয়ে জাগরণ তৈরি করলেও রাষ্ট্র তাঁর মূল্যায়ন কমই করেছে! লোকসংস্কৃতির গবেষকেরা বলছেন, শাহ আবদুল করিমকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে রাষ্ট্র তার দায় কিছুটা হলেও এখন মেটাতে পারে।