সান্ত্বনার হস্তশিল্পের প্রচার ও প্রসারে ভরসা ইন্টারনেট
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের হরিদাস গ্রাম। এ গ্রামের বাসিন্দা ‘মার্শাল-আর্ট কন্যা’খ্যাত সান্ত্বনা রানী রায়। তিনি ‘সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্রাফটস’–এর উদ্যোক্তা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রচারের সুবাদে ইতিমধ্যেই সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন সান্ত্বনা। চেনা-জানা, পরিচিত-অপরিচিত লোকজন আসেন এই গ্রামে মার্শাল-আর্ট ‘তায়কোয়ান্দো’ আর সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্রাফটসের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে। পাশাপাশি দেখেন তায়কোয়ান্দোর প্রশিক্ষণ এবং ক্রয় করেন পছন্দের হস্তশিল্প।
গ্রামীণফোনের ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের আওতায় দেশের দুই হাজারের বেশি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে উঠান বৈঠক। গত ৫ ডিসেম্বর বেলা তিনটায় হরিদাস গ্রামের সান্ত্বনার বাড়িতে আয়োজন করা হয় উঠান বৈঠকের। বেলা আড়াইটার মধ্যে হরিদাসসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন বয়সী নারী বৈঠকে উপস্থিত হন। তাঁদের অনেকের হাতে ছিল স্মার্টফোন।
জানা যায়, ২০১৭ সালে নিজ গ্রামের বাড়িতে সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্র্যাফটস নামে একটি উন্নয়ন সংস্থা গড়েছেন সান্ত্বনা রানী রায়। এখানে স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছাত্রীরাসহ বিভিন্ন পেশা ও বয়সের নারীরা নানান রকম হাতের কাজ করেন এবং প্রশিক্ষণ নেন। সেগুলো হলো নকশিকাঁথা, বেডশিট, থ্রিপিস, টুপিস, ওয়ানপিস, পুঁতি ও বেতি দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ তৈরি, মুঠোফোন রাখার ব্যাগ তৈরি, পুতি ও সুতার সমন্বয়ে গলার মালা সেট, কানের দুল, মাথার ক্লিপ, পাটের আঁশের শিকা ইত্যাদি।
সান্ত্বনার মাধ্যমে ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের হরিদাস, ডাকাতপাড়া, যুগীটারি ও সরলখা, সাপ্টিবাড়ির পাঁচপাড়া, মসুর দৈলজোর ও ফলিমারী এবং লালমনিরহাট সদরের মহেন্দ্র নগর ইউনিয়নের তেলিপাড়া গ্রামের নানা বয়সী প্রায় চার শতাধিক নারী বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। ২০২৫ সালের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই নারীর সংখ্যা ৫০০ করার পরিকল্পনা রয়েছে সান্ত্বনা রানীর। পাশাপাশি উৎপাদনসামগ্রীর পরিমাণ ও গুণগত মানের উন্নয়নও ঘটাতে চান তিনি।
সান্ত্বনা রানী বলেন, ‘সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্রাফটসের বিভিন্ন পণ্য লালমনিরহাট জেলাসহ রংপুর ও রাজধানী ঢাকায় বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে ব্যক্তিগত এবং বিভিন্ন দোকান ও শোরুম পর্যায়ে নেওয়া হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ ও শহুরে মেলায় এবং অনলাইনভিত্তিক অর্ডারের বিপরীতে সুলভে বিক্রি করা হয়।’
উঠান বৈঠক চালাকালে দেখা মেলে একজন ক্রেতার, লালমনিরহাট শহরের উচাটারীর ফারাহ নাজ নাহার ফিবা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। ফিবা বলেন, ‘আমি ফেসবুকের মাধ্যমে সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্রাফটসের বাহারি নকশিকাঁথা দেখেছি। এরপর সুলভ মূল্যে লাল ও খয়েরি রঙের দুটি নকশিকাঁথা কিনেছি।’
নিজ বাড়ির উঠানে আয়োজনটি সম্পর্কে সান্ত্বনা রানী বলেন, ‘এই বৈঠকের মাধ্যমে আমিসহ গ্রামের নারীরা অনেক কিছু শিখতে পারলাম। ইন্টারনেটে আমাদের হস্তশিল্পের প্রচার বাড়লে আরও বেশি মানুষ এ সম্পর্কে জানতে পারবেন। এতে স্বল্প লাভে বেশি বিক্রি করে আমরা লাভবান হতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এ জন্য সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্র্যাফটস নামের একটা ফেসবুক পেজ খুলেছি। এর মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ ও উৎপাদনসামগ্রীর অনলাইনে মার্কেট প্লেসে পণ্য বিক্রি করে দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে পারব বলে আশাবাদী।’
সান্ত্বনা রানীর আরেক পারদর্শিতা হলো তায়কোয়ান্দো। তাঁর হাত ধরে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেকে। তাঁদের একজন হরিদাস গ্রামের বাসিন্দা ও কলেজপড়ুয়া সাথী রানী রায়। তিনি বলেন, ‘নিজের নিরাপত্তার জন্য খালি হাতে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আমি মার্শাল আর্ট তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিয়েছি। জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে স্বর্ণ ও রৌপ্যপদক জিতেছি। পাশাপাশি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্রাফটসে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাহারি নকশিকাঁথা তৈরি করে বিক্রি করি। আমার মতো শত শত নারী আছেন, যাঁরা সান্ত্বনা রানীর মাধ্যমে শারীরিক ও আর্থিক নিরাপত্তা অর্জনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।’
সান্ত্বনা রানী ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। পাশাপাশি অর্জন করেছেন বিপিএড এবং এলএলবি ডিগ্রি। মার্শাল আর্ট তায়কোয়ান্দোতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫টি স্বর্ণ, ৪টি রৌপ্য ও ২টি ব্রোঞ্জপদক লাভ করেন। বিবিসি বাংলা, রয়টার্স, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারসহ অনেক নামীদামি গণ্যমাধ্যমে মার্শালআর্ট কন্যা সান্ত্বনার ওপর সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
বাবা, ভাই, এক বোন ও দাদিকে নিয়ে সান্ত্বনার ছোট্ট সংসার। মা যমুনা রানী প্রয়াত। বোনের বিয়ে হয়েছে। ৪০ বছর বয়সী সান্ত্বনা অবিবাহিত। লালমনিরহাটের আদিতমারীর এক নিভৃত পল্লির প্রান্তিক কৃষক পরিবারের মেয়ে সান্ত্বনা। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই মেয়ের বিয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাবা সুবাস চন্দ্র রায়। সেদিন যদি সান্ত্বনা বাল্যবিবাহের কাছে হার মানতেন, তাহলে সম্ভব হতো না উচ্চশিক্ষিত, মার্শালআর্ট কন্যা বা উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা।
সান্ত্বনা বলেন, ‘নিজের বিয়ে ও সংসার নিয়ে ভাবার সময় পাইনি। আমি শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের আনন্দ উপভোগ করতে পারিনি। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখেছি। প্রতিষ্ঠা করেছি লালমনিরহাট তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশন (এলটিএ) এবং সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্র্যাফটস। দুটি প্রতিষ্ঠানই এখন আমার স্বপ্ন-সাধনা।’
উদ্যোক্তা ও মার্শালআর্ট কন্যা সান্ত্বনা রানী রায়ের মতো আরও অনেক গ্রামীণ নারীর জীবনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ কার্যক্রমটি। মানুষের নানাবিধ চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে ইন্টারনেট যে সক্ষম, সে বিষয়টি তৃণমূলের নারীদের সরাসরি শেখাতে এ উদ্যোগ। প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার স্থানীয় সদস্যদের সহযোগিতায় সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নেরও বেশি স্থানে চলছে উঠান বৈঠক। যার মধ্যে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নও রয়েছে। গ্রামীণফোনের উদ্যোগে এই আয়োজনের সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৪৯টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে উঠান বৈঠক।