ডেঙ্গুর ভরা মৌসুমে মশা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কেন উদাসীন

ডেঙ্গুফাইল ছবি: বাসস

চট্টগ্রামে ধীরে ধীরে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হচ্ছে রোগীদের। কেউ কেউ বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। অবশ্য ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে এখনো গত বছরের মতো প্রকট হয়নি। তবে বিপদ দূর হয়নি, কেননা এডিস মশার প্রজননের মূল মৌসুম শুরু হচ্ছে চলতি জুলাই মাসে। চলবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। গত বছরের বিপর্যয় মাথায় রেখে এখনই মশা নিধন কার্যক্রমে জোর দেওয়া উচিত বলে চিকিৎসকেরা মত দিলেও সিটি করপোরেশনের এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিলেন ১০৭ জন। আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৪ হাজার ৮৭ জন। আর চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনজন। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এখন ২৭৩। তাঁদের মধ্যে জুলাইয়ের প্রথম ১২ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৫ জন। জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪১ জন। অবশ্য গত বছর এমন সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল অনেক। শুধু জুলাইতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ৩১১ জন। মারা গিয়েছিলেন ১৬ জন।

গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ডেঙ্গু নিয়ে নগরবাসীর মনে আশঙ্কা থাকলেও মশা বাড়ছেই। গত বছর ঢাকঢোল পিটিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এবার তেমন কর্মসূচিও দেখা যাচ্ছে না। অথচ এখন এডিস মশার প্রজননকালের চূড়ান্ত সময়। এ সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপও বাড়ে।

গত বছর জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে ড্রোন উড়িয়ে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ছিল ক্রাশ প্রোগ্রাম। প্রজনন মৌসুম শুরুর আগেই এডিস মশার হটস্পটগুলো (বেশি সংক্রমণ এমন এলাকা) চিহ্নিত করা হয়েছিল। আবার যেসব ভবন ও নির্মাণাধীন ভবনে মশার প্রজননস্থল খুঁজতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করেছিল সিটি করপোরেশন। অবশ্য এসব উদ্যোগের পরও ডেঙ্গুর প্রকোপ থামানো যায়নি। বরং অতীতের সব রেকর্ড ছড়িয়ে গিয়েছিল।

ডেঙ্গু নিয়ে ২ জুলাই একটি সভা করে সিটি করপোরেশন। অন্যান্য বছর এ ধরনের সভায় গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও এবার তা হয়নি। এ সভায় কী ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা-ও জানানো হয়নি। উল্টো শুধু জনগণের সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। এর আগে গত ৩০ মার্চ মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছিলেন, মশা নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় জানতে এপ্রিলের মধ্যে গবেষণাগার চালু হবে। কিন্তু ঘোষণার সাড়ে তিন মাস পার হলেও এখনো তা চালু হয়নি।

সিটি করপোরেশনের এমন ‘নিষ্ক্রিয়’ অবস্থায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। আবার অনেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আছেন আতঙ্কে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। এতে বাড়তি অর্থ খরচ হচ্ছে তাঁদের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই খাতের খরচ।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম নগরের ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের পূর্ব কাঠগড়ের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী শাহেদ হাসান। চার দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। তিনি বলেন, বাড়ি ও কর্মস্থল—দুই জায়গার কোথাও মশার ওষুধ ছিটাতে কাউকে দেখেননি। যেখানেই ছিলেন মশার কামড় খেয়েছেন। তাই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না, কোন জায়গা থেকে আক্রান্ত হয়েছেন? নিজের এলাকায় ওষুধ ছিটানোর জন্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে অনেকবার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি, ওষুধ কেনায় অনেক টাকা খরচ হয়েছে।

নগরের টাইগারপাসে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী প্রধান কার্যালয় থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে লালখান বাজারে অবস্থিত সরকারি অফিসার্স কলোনি। এখানে পরিবার নিয়ে থাকেন ফারজানা আক্তার। ডেঙ্গুর মৌসুমে দুই শিশু সন্তান নিয়ে আছেন বাড়তি দুশ্চিন্তায়। তিনি বলেন, মশার উৎপাতের কারণে বাচ্চাদের নিয়ে আতঙ্কে থাকেন। মশার কামড় থেকে রক্ষায় তাদের লোশন দেন। মশারিও টানানো হয়। তারপরও মশা কামড়াচ্ছে।

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি এবং নগরবাসী আতঙ্কে থাকলেও সিটি করপোরেশনের দাবি হচ্ছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি তৎপর তারা। তাই রোগীর সংখ্যা কম।

সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এবার মশা নিধনের ওষুধের কোনো ঘাটতি নেই। মশা মারার রুটিন কাজও অব্যাহত আছে। তবে গতবার যেসব কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল, এবারও তা নেওয়া হবে। আগামী সপ্তাহে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু হবে। হটস্পট চিহ্নিত করার কাজও চলছে। প্রচারণা অব্যাহত আছে। গবেষণাগারও আগামী মাসে চালু হবে। তবে ওষুধ ছিটানোর দায়িত্বে থাকা কর্মীদের কিছুটা গাফিলতি এবং জনসচেতনতার অভাবে মশকনিধন কার্যক্রমে বড় ঘাটতি বলে মন্তব্য করেছেন মো. শরফুল ইসলাম।

পরিসংখ্যানগতভাবে রোগীর সংখ্যা কম মনে হলেও ডেঙ্গু নিয়ে বিপদ এখনো দূর হয়নি বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের চূড়ান্ত সময় হচ্ছে জুলাই-আগস্ট। এ বছরের তুলনায় গত বছর আক্রান্ত বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে তখন আগাম বৃষ্টি হয়েছিল। এবার এখন পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ কম। তবে এখন বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ছে। তাই ডেঙ্গুর প্রকোপও বাড়তে পারে। এ জন্য আগাম সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।