শিক্ষকের বটের ছায়ায়
বিয়েতে লোকে গয়নাগাটি, জামাকাপড়, আসবাব, টাকাপয়সা কত কিছুই না উপহার দেয়। সেখানে বিয়ের নিমন্ত্রণে চারাগাছ নিয়ে হাজির হতেন তিনি। সেই উপহার দেখে লোকে হাসাহাসি করত। অবশ্য শিক্ষক বলে কেউ কিছু বলত না। অনেকে বিষয়টাকে ‘পাগলামি’ও ভাবত। কিন্তু সেসব ঠাট্টা–বিদ্রূপ গায়ে মাখেননি তিনি। সুযোগ পেলেই মানুষকে গাছের চারা উপহার দেন। আর জায়গা পেলেই চারা রোপণ করেন।
অন্যদের উপহারের কথা ভুলে গেছে লোকে। কিন্তু শিক্ষকের উপহারের চারাগুলো এখন অনেক বড়। একেকটা মহিরুহ প্রায়। সেই বৃক্ষের ফল, ছায়ায় মনপ্রাণ জুড়ায় মানুষের। লোকে এখন শ্রদ্ধাভরে তাঁর নাম নেয়। আর সেই শিক্ষক মানুষটি নিজের টাকায় গত ৪২ বছরে রাস্তার পাশে, হাটে–বাজারে, গ্রামের মোড়ে, ঈদগাহ মাঠে, সরকারি খালি জায়গা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে চারা লাগিয়ে চলেছেন।
তাঁর ঝোঁক বেশি বটগাছের প্রতি। গাছটা সহজে মরে না, শীতল ছায়া দেয়। তার চেয়েও বড় কথা, বটের চারা লাগিয়ে তিনি শান্তি পান। বৃক্ষপ্রেমী মানুষটির নাম এস এম জুলফিকার আলী। লোকে তাঁকে সমীহ করে লেবু মাস্টার নামে ডাকে। বাড়ি তাঁর জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ছবিলাপুর গ্রামে। উপজেলার কে জি এস মহর সোবাহান মফিজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিনি। শুধু গাছ লাগিয়েই থেমে নেই। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, পাঠাগার গড়াতেও এগিয়ে তিনি। কারও দুঃখ–কষ্ট দেখলে পাশে দাঁড়ান। নিজের বেতনের টাকা অকাতরে অন্যের জন্য ব্যয় করেন। এ জন্য এলাকায় মানবিক মানুষ বলেও লোকে তাঁকে চেনে।
শুরুটা যেভাবে
জুলফিকারের বাবা মো. আলাউদ্দিন সরকার ছিলেন কৃষক। অভাব-অনটনের সংসার। এর মধ্যেই গাছের প্রতি ভালোবাসা জন্মে জুলফিকারের। ভাইদের সবার বড় হওয়ায় সংসারের বাজারসদাইয়ের ভার তাঁর কাঁধেই পড়ত বেশি। সেই বাজারখরচা থেকে টাকা বাঁচিয়ে তিনি গাছের চারা কিনতেন।
১৯৮২ থেকে জুলফিকার বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগানো শুরু করেন। তাঁর বয়স এখন ৫৬। এখনো তিনি অবিরাম গাছ লাগিয়ে চলেছেন। শুধু মেলান্দহই নয়, জামালপুর সদর উপজেলা, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ীতেও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর গাছ। এ পর্যন্ত দুই শতাধিক বটগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ১০ হাজার গাছ তিনি লাগিয়েছেন বলে জানালেন। আর প্রতিবছর তাঁর স্কুলের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের গাছের চারা উপহার দিয়ে বিদায় জানান, জানালেন জুলফিকার।
১৯৮২ থেকে জুলফিকার আলী বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগানো শুরু করেন। তাঁর বয়স এখন ৫৬। শুধু মেলান্দহই নয়, জামালপুর সদর উপজেলা, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ীতেও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর গাছ। এ পর্যন্ত দুই শতাধিক বটগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ১০ হাজার গাছ তিনি লাগিয়েছেন
সম্প্রতি ছবিলাপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় জুলফিকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক সভায় গিয়ে জানতে পারেন, গাছ লাগালে পুণ্য হয়। তখন থেকেই গাছ লাগানোর চিন্তা মাথায় আসে। শুরুতে সব ধরনের গাছ লাগাতেন। পরে তাঁর মাথায় আসে বটগাছের কথা। বটগাছ একসঙ্গে অনেককে ছায়া দেয়। বটগাছের ফল পাখি ভালোবাসে। এতেই গাছটির প্রতি তাঁর ঝোঁক বাড়ে। তিনি দেখেন, গ্রামের ঈদগাহ মাঠে কোনো গাছ নেই। সেখানে একটি বটের চারা লাগান। পরে গ্রামের একমাত্র স্কুলমাঠের খালি জায়গায় লাগান বটগাছ। এভাবেই বটগাছ লাগানোর শুরুটা হয়।
বটগাছের রাজত্ব
মেলান্দহের রাস্তাঘাটে, স্কুল-কলেজের মাঠে ও হাটবাজারে বটগাছ চোখে পড়ে। এর প্রায় সবই জুলফিকারের লাগানো। এ ছাড়া পাশের জেলা শেরপুর ও বগুড়ার কিছু স্থানেও আছে জুলফিকারের লাগানো বটগাছ। এখন পরিকল্পনা করছেন দেশের সব রেলওয়ে স্টেশনে তিনি বটগাছ লাগাবেন।
মেলান্দহের ঘোষেরপাড়া চৌরাস্তা বাজারে বটতলায় বিশ্রাম নেওয়ার সময় কথা হয় ছবিলাপুর গ্রামের আবদুল মমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, উপজেলার যেখানেই বটগাছ দেখবেন, সেটাই লেবু স্যারের লাগানো। তিনি শুধু গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি। গাছ বড় হওয়ার পর এর নিচে বসার জন্য পাকা বেদিও করে দিয়েছেন।
দক্ষিণ কাহেতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই গাছ লাগানো জুলফিকারের নেশা।’
বটের চারা বেশি লাগান কেন জানতে চাইলে জুলফিকার আলী বলেন, ‘বটের ছায়া শীতল। সেখানে একত্রে অনেক মানুষ বসতে পারে। বটগাছ সহজে মরেও না। দেশে একসময় অনেক বটগাছ ছিল। এখন সংখ্যায় কমে এসেছে। বটগাছ লাগালে আমি আলাদা শান্তি পাই।’
চারা যখন উপহার
১৯৯৩ থেকে জুলফিকার বিয়েশাদিতে নিয়মিত গাছের চারা উপহার হিসেবে দিয়ে আসছেন। জুলফিকারের মামাতো বোন খালেদা আমিন। ১৯৯৩ সালে মাদারগঞ্জের গুনারীতলায় বিয়ে হয় তাঁর। বিয়েতে দুটি চারা উপহার দেন জুলফিকার। খালেদা বলেন, ‘সেই সময় অনেকেই বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। ওই গাছ দুটি আমার শ্বশুরবাড়িতে লাগানো হয়েছিল। দুটি গাছের মধ্যে একটি ফলদ গাছ ছিল। সেই গাছটিতে ফল ধরে, সেই ফল এখন সন্তান ও নাতি-নাতনিরা খাচ্ছে।’
মেলান্দহের কাহেতপাড়া এলাকার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার বিয়েতেও লেবু স্যার একটি চারা উপহার দিয়েছিলেন। এ নিয়ে বিয়েতে আসা অনেকে হাসিঠাট্টা করেছিলেন তখন।’
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা তো আছেই। সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী একটা স্মৃতিও থাকবে—মূলত এমন ভাবনা থেকেই বিভিন্ন দাওয়াতে গাছের চারা উপহার হিসেবে নিয়ে যান জুলফিকার। তিনি বলেন, ‘আমি হয়তো একসময় থাকব না। কিন্তু গাছটি থাকবে। তখন কেউ না কেউ আমার কথা স্মরণ করবে।’
ছেলের জন্য গর্ব হয়, বললেন জুলফিকার আলীর বৃদ্ধ মা জুলেখা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে কখনো তার নিজের ও পরিবারের কথা ভাবে না। যা বেতন পায়, সেই টাকা দিয়ে মানুষকে সহায়তা করে। নিজের টাকায় সব জায়গায় গাছ লাগায়। কারও কোনো বিপদ হইলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
বাল্যবিবাহ ঠেকান, আছে পাঠাগার
গ্রামের কোথাও বাল্যবিবাহের খবর পেলেই ছুটে যান জুলফিকার। পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে বাল্যবিবাহের হাত থেকে কিশোরীদের রক্ষা করেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় অনেক কিশোরী বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাদের মধ্যে মেলান্দহের চর ঘোষেরপাড়া এলাকার কৃষক মো. সুরুজ্জামানের দুই মেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। দুই মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় দারিদ্র্যের কারণে সুরুজ্জামান তাঁদের বিয়ে ঠিক করেছিলেন।
জানতে চাইলে সুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লেবু মাস্টার অসাধারণ মানুষ। দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদের আয় দিয়ে কোনোভাবেই সংসার চলছিল না। সেখানে কীভাবে সন্তানদের লেখাপড়া করাব? ছোটবেলায় দুই মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লেবু মাস্টারের কল্যাণে ওই সময় তাঁর মেয়েরা বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পায়। বড় মেয়েটি ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে এখন এমপিওভুক্ত একটি কলেজে শিক্ষকতা করছে। আর ছোটটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করেছে।’
তিনি (জুলফিকার আলী) শিক্ষক হিসেবেও ভালো। উপজেলা পর্যায়ে সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ভালো কবিতাও লেখেন। সত্যি বলতে তিনি একজন মানবিক মানুষ। সমাজে এই ধরনের মানুষ এখন খুব কম।আজাদুর রহমান ভূঁইয়া, মেলান্দহ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা
মানুষকে বই পড়ায় আগ্রহী করতে এই শিক্ষক ২০০১ সালে বাড়ির সামনে নিজের জায়গায় গড়ে তোলেন একটি পাঠাগার। সাহিত্য, ইতিহাস, জীবনীগ্রন্থ, বিশ্বকোষসহ নানা বইয়ে সমৃদ্ধ ছিল পাঠাগারটি। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নানা বয়সী পাঠকদের পদচারণে মুখর থাকত। নানা বয়সী মানুষের সুবিধার জন্য পাঠাগারের পাশেই পুকুরপাড়ে বসার জায়গা করে দিয়েছেন। পাড়ে একটি বটগাছও রয়েছে। বই পড়ার সুবিধার জন্য গাছের নিচে পাকা করে দেওয়া হয়েছে।
গত ৬ আগস্ট রাতে কে বা কারা পাঠাগারের তালা ভেঙে বইগুলো পুকুরে ফেলে দিয়েছে। ওই দিন থেকে বাইরে বই পড়া বন্ধ রয়েছে। তবে বাড়িতে যেসব বই ছিল, সেসব বই লোকজন এখনো নিয়ে পড়েন। নতুনভাবে আবারও পাঠাগারটি চালুর উদ্যোগ নিচ্ছেন জুলফিকার।
মানবিক এই শিক্ষক সম্পর্কে জানতে চাইলে মেলান্দহ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজাদুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি শিক্ষক হিসেবেও ভালো। উপজেলা পর্যায়ে সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ভালো কবিতাও লেখেন। সত্যি বলতে তিনি একজন মানবিক মানুষ। সমাজে এই ধরনের মানুষ এখন খুব কম।’