গাজীপুরে স্বতন্ত্রদের পক্ষে জাহাঙ্গীর, অস্বস্তিতে নৌকার প্রার্থীরা
আসন তিনটিতে আওয়ামী লীগের তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রচার–প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন জাহাঙ্গীর আলম।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ভোটের জন্য ছুটছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। এতে গাজীপুরে তৈরি হয়েছে ভোটের নতুন সমীকরণ। জাহাঙ্গীরের কারণে অস্বস্তিতে পড়েছেন তিনটি আসনে আওয়ামী লীগে প্রার্থীরা।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দুবার আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হন। দুবারই বিশেষ বিবেচনায় দল তাঁকে ক্ষমা করে। বর্তমানে তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মা জায়েদা খাতুনের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার সংসদ নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাসেল, গাজীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিম উদ্দিন এবং গাজীপুর-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও গাজীপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানের পক্ষে কাজ করছেন।
তিনটি আসনের মধ্যে গাজীপুর-১ আসনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর-২ আসনে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও গাজীপুর-৫ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি নৌকার হয়ে নির্বাচন করছেন।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই আসনগুলোতে ওই তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য কাজ করছেন জাহাঙ্গীর আলম। প্রতীক বরাদ্দ উপলক্ষে ১৮ ডিসেম্বর শহরের রাজবাড়ি মাঠে কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থকের সমাগম ঘটান তিনি। সেখানে ওই তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন জাহাঙ্গীর।
গাজীপুর–১, ২ ও ৫ আসন
■ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য কাজ করছেন জাহাঙ্গীর আলম।
■ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হয়ে জাহাঙ্গীরের প্রচারণার ফলে গাজীপুরে তৈরি হয়েছে ভোটের নতুন সমীকরণ।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ নেওয়ার বিষয়ে ১৮ ডিসেম্বর রাজবাড়ি মাঠে নেতা–কর্মীদের উদ্দেশে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, প্রত্যেকে নির্বাচন করতে পারবেন, কোনো প্রার্থী যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে না পারেন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনকে একটা সুন্দর ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন উপহার দিতে চাই। সে লক্ষ্যে আমরা (৩ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে) নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। এটাকে যেন কেউ ভুলভাবে ব্যাখ্যা না দেন। আমাদের প্রত্যেকের রক্তে আওয়ামী লীগ। আমরা জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগ করি।’
জাহাঙ্গীর ‘ফ্যাক্টর’
স্থানীয় নেতা–কর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিম উদ্দিনের। রেজাউল করিমও দীর্ঘদিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তবে ভোটের মাঠে তাঁদের কারোরই সেভাবে পরিচিতি নেই। জনসম্পৃক্ততাও কম। নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা দিলেও তাঁদের নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম তাঁদের পক্ষ নেওয়ায় পাল্টে গেছে দৃশ্যপট।
জাহাঙ্গীরের ভূমিকাকে অস্বস্তিকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও গাজীপুর সদরে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল হাদী (শামীম)। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীর আলম হয়তো জনপ্রিয়। আর সে সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করছেন। এর ফলে কোন নেতা কার পক্ষে কাজ করছেন বা কে কার লোক তা বোঝা যাচ্ছে না। এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর। পাশাপাশি কর্মী–সমর্থকদের মধ্যেও এসব নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি দেখা দিয়েছে।’
নেপথ্যে পুরোনো বিরোধ
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গোপনে ধারণ করা জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই কথোপকথনে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতে শোনা যায় জাহাঙ্গীর আলমকে। এর জের ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের তীব্র প্রতিবাদের মুখে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একপর্যায়ে হারান মেয়র পদ। সব হারিয়ে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন জাহাঙ্গীর। পরে অবশ্য দল থেকে ক্ষমা করা হয় তাঁকে।
এর জের ধরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আজমত উল্লা খানের বিপক্ষে জাহাঙ্গীর স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। পাশাপাশি মা জায়েদা খাতুনকেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। পরে খেলাপি ঋণের কারণে জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল হলে মায়ের হয়ে ভোটের প্রচারে নামেন। নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে জয় পান জায়েদা খাতুন। সিটি নির্বাচনের মধ্যেই দল থেকে আবারও বহিষ্কৃত হন জাহাঙ্গীর। চলতি বছরের অক্টোবরে দল থেকে আবারও ক্ষমা করা হয় তাঁকে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, জাহাঙ্গীর আলমের শাস্তির দাবিতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন আজমত উল্লা খান।
পরে সোচ্চার হন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ অনেকে। সেখান থেকেই বিরোধের শুরু। এসবের জের ধরে এবারে সংসদ নির্বাচনেও আ ক ম মোজাম্মেল হক ও জাহিদ আহসানের বিপক্ষে নেমেছেন বলে দাবি তৃণমূলের অনেক নেতা–কর্মীর।