‘দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে’ ডাকাত আতঙ্ক
সুন্দরবনে আবার দেখা দিয়েছে ডাকাত আতঙ্ক। খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার বনজীবী জেলে ও মহাজনদের দাবি, প্রশাসন থেকে দস্যুমুক্ত সুন্দরবন ঘোষণা দেওয়া হলেও নজরদারির অভাবে দীর্ঘদিন পর আবার বেড়েছে ডাকাতের উৎপাত।
গহিন সুন্দরবনে ডাকাতের হাত থেকে বেঁচে ফেরা কয়েকজন মৎস্যজীবী জানান তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা জানান, গত রোববার রাতের বেলা হঠাৎ করেই রামদা, লাঠি, বন্দুক নিয়ে আক্রমণ করে ডাকাত দল। এ সময় তাঁদের তিনটি নৌকা থেকে ৩টি মুঠোফোন, ১ মণ কাঁকড়া, ২ মণ মাছ লুট করে ডাকাতেরা। গত সোমবার জেলেরা বাড়ি ফিরলে এ খবর জানা যায়।
সুন্দরবনের হংসরাজ নদের আশপাশের এলাকায় একটি ডাকাত দল খুব বিরক্ত করছে। জেলেদের মাধ্যমে আমরা ডাকাতির খবর জেনে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাকাতদের ব্যবহৃত নৌকাটি জব্দ করেছি। বনরক্ষীদের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতেরা নৌকা ফেলে বনের মধ্যে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের আটক করতে পারিনি।
খুলনার কয়রা উপজেলার পল্লিমঙ্গল গ্রামের বনজীবী জেলে ইউনুস আলী সানা বলেন, ‘আমরা বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে টানা ছয় দিন সুন্দরবনের মধ্যে মাছ ও কাঁকড়া ধরে গত রোববার সুন্দরবন থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিই। আমরা তিনটি নৌকায় ছয়জন লোক ছিলাম। মধ্যরাতে হংসরাজ নদ ধরে সুন্দরবনের আলকি এলাকায় পৌঁছালে কয়েকটি নৌকায় ১০-১২ জনের ডাকাত দল আমাদের ঘিরে ধরে। ডাকাতদের হাতে বন্দুক রামদা আর লাঠি ছিল। আমাদের নৌকা থেকে মাছ, কাঁকড়া, মুঠোফোন ও টাকা নিয়ে গেছে ডাকাতেরা।’
আরেক জেলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘ডাকাতেরা বলেছে তাদের বাহিনীর নাম “সুন্দরবন বাহিনী”। এখন থেকে বনে এলে তাদের টাকা দিয়ে মাছ, কাঁকড়া ধরতে হবে। আমাদের কাছে দেড় লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে ডাকাতেরা।’ জেলে মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘নৌকায় আমার পাশে যে ডাকাত দাঁড়িয়ে ছিল, তার হাতে ছিল রিভলবার। পাশেই আরেকজনের হাতের বন্দুকের নল জ্বলজ্বল করছিল। বড্ড ভয় পেয়েছি। আমার নৌকা থেকে মাছ-কাঁকড়া নেওয়ার পর যখন খাওয়ার পানির ড্রামও নিয়ে যাচ্ছিল, তখন একটু সাহস করে বলেছিলাম, খাওয়ার পানিটা অন্তত রেখে যান। তখন আমাকে ধমক দিয়ে এক ডাকাত বলল, “পিপাসা লাগলে নিজের প্রস্রাব খাবি”। ভয়ে আমি আর কিছু বলতে পারিনি। একেবারে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরেছি। গত ১৫ দিন আগে দাকোপ উপজেলার পানখালী গ্রামের আমার এক আত্মীয়কে সুন্দরবনে ডাকাতেরা ব্যাপক মারপিট করে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। প্রশাসনের নজরদারি কম হওয়ায় ফের ডাকাতি শুরু হয়েছে।’
কয়রা উপজেলার ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের আবুল খায়ের ও জাহিদ মোল্যা গত ১৫ দিনে দুবার সুন্দরবনের একই এলাকায় ডাকাতের মুখোমুখি হয়েছেন বলে জানান। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এই দুই বনজীবীর সঙ্গে দেখা হয় ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের লঞ্চঘাটে গিয়ে। আবুল খায়ের বলেন, ‘হংসরাজ নদের নিশিনখালী এলাকায় ডাকাত দল আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অতর্কিতভাবে আমার ওপর হামলা চালায়। ডাকাতেরা আমার শিকার করা কাঁকড়া, মুঠোফোন, নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়।’
বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডাকাত দলটি এক মাস ধরে সুন্দরবনের গেওয়াখালী, আলকি, নিশিনখালী এই এলাকা দিয়ে লুটতরাজ করে চলেছে। ১০ থেকে ১২ জনের এই ডাকাত দলের অধিকাংশ সদস্যের বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায়।
সম্প্রতি ডাকাতদের উপদ্রব বেড়ে যাওয়া ওই সব এলাকা বন বিভাগের নলিয়ান ফরেস্ট স্টেশনের আওতাধীন। নলিয়ান ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা তানজিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনের হংসরাজ নদের আশপাশের এলাকায় একটি ডাকাত দল খুব বিরক্ত করছে। জেলেদের মাধ্যমে আমরা ডাকাতির খবর জেনে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাকাতদের ব্যবহৃত নৌকাটি জব্দ করেছি। বনরক্ষীদের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতেরা নৌকা ফেলে বনের মধ্যে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের আটক করতে পারিনি।’
বন কর্মকর্তা তানজিলুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি টহল ফাঁড়িকে এই ডাকাত দলের বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। দ্রুত আরও জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সুন্দরবনে ডাকাতদের কোনো তৎপরতা চলতে দেওয়া হবে না।’