৫ বছরে ঝরল ২৮ ভাগ শিক্ষার্থী

করোনা মহামারির কারণে দুই দফায় প্রায় ১৯ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এই দীর্ঘ বিরতিতে রাজশাহীতে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।

ফাইল ছবি

রাজশাহী জেলায় পাঁচ বছরে অর্থাৎ পঞ্চম থেকে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত আসতে ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। শিক্ষকেরা বলছেন, করোনাকালে দেড় বছরের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। এর মধ্যে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমে যুক্ত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আর বিদ্যালয়ে আসছে না।

আজ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেসকোর সাধারণ সম্মেলনে এ দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর রাজশাহীতে ৭১ দশমিক ৯১ শতাংশ। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার এ হার চিন্তার বিষয় বলে জানিয়েছেন শিক্ষক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় ও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ২০১৫ সালে ৪৬ হাজার ৩২৪ জন শিক্ষার্থী পিইসি (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যেই ৭ হাজার ৭ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। পরীক্ষা দেয় ৩৯ হাজার ৩১৭ জন শিক্ষার্থী। ২০২১ সালে তারা এসএসসি পরীক্ষা দেয়। ওই সময় আরও ছয় হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। সব মিলিয়ে ৫ বছরে জেলায় ১৩ হাজার ৭ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

নগরের তালাইমারি এলাকার এক বেসরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, তাঁর বিদ্যালয়ে চর এলাকার শিক্ষার্থী রয়েছে। ছাত্রীরা মূলত বাল্যবিবাহের কারণে ঝরে পড়ে। শিক্ষার্থীদের মা-বাবা তাঁদের বলেন, মেয়ে বড় হলে নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের ভাবতে হয়। এ জন্যই ছোট থাকতে বিয়ে দিয়ে তাঁরা নির্ভার হতে চান। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যেতে তাঁর বিদ্যালয়ের অর্ধেকের বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। মামলা ও জরিমানা করেও এই বাল্যবিবাহের প্রবণতা কমছে না।

নগরের রেলগেট এলাকায় একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজে কথা হয় আলিফের সঙ্গে। সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা বাসচালক। দুই ভাই–বোনের মধ্যে সে বড়। দুই বছর ধরে সে মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ শিখছে। গ্যারেজের কাজের চাপের জন্য নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। সপ্তাহে গ্যারেজের মালিক তাকে হাজারখানেক টাকা দেন। সে বলে, তার বাবা অসুস্থ। যেকোনো সময় তার বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এ আশঙ্কায় সে কাজ শিখছে। কাজ শেখা শেষ হলে নিজেই একটা গ্যারেজ দেবে। তখন আর বাবাকে গাড়ি চালাতে দেবে না।

আলিফ তালাইমারি এলাকার আলোর পাঠশালার শিক্ষার্থী। বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সে মেধাবী। সংসারের হাল ধরার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সে বিদ্যালয়ে অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে।

সাহেববাজারে মাছের দোকানের কিশোর কর্মচারী হাসিব নবম শ্রেণিতে পড়ে। দোকানে মাছে আঁশ ছড়ানো ও মাছ কাটার কাজ করে। সে সম্প্রতি বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। নবম শ্রেণিতে ওঠার পরে এসএসসি পরীক্ষার জন্য নাম নিবন্ধন করাতে হয়। পারিবারিক সমস্যার কারণে সে এই নিবন্ধন ফি জমা দিতে পারেনি। এখন প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত তাকে দোকানে সময় দিতে হয়। তার পড়াশোনার ইচ্ছা আছে, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

শহরের তিনটি উচ্চবিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা মহামারির কারণে ৫৪৩ দিন বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও শ্রেণি কার্যক্রম চলছিল স্বল্প পরিসরে। নতুন করে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর ২১ জানুয়ারি আবার এক মাসের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। এই দীর্ঘ বিরতিতে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। তাদের ফিরিয়ে আনতে তাঁরা নানাভাবে চেষ্টা চালান। তবে চেষ্টা চালানোর পরও তাঁদের বিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষার্থী ঝরে গেছে।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দারিদ্র্য ও বাল্যবিবাহের কারণে বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার বিষয়ে অমনোযোগী হয়ে পড়ার একটা প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। ঝরে পড়া রোধে তাঁরা অভিভাবক সমাবেশ করে থাকেন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সময়ও এ ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে। শিক্ষকেরা এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে পরিস্থিতির উন্নয়নের চেষ্টা করছেন।