প্রতি মাসে একটি ভালো কাজ

নূরুল ইসলামের ভালো কাজগুলোর মধ্যে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে গাছ লাগানো, খাঁচা দিয়ে গাছ সংরক্ষণ করা, নিয়মিত পরিচর্যা করা। তাঁর মতে, ‘গাছ আমাদের পরম বন্ধু। নিঃস্বার্থভাবে আমাদের ফল দিয়ে, ফুল দিয়ে, প্রকৃতিতে অক্সিজেনের জোগান দিয়ে এবং ক্ষতিকর সব গ্যাস শুষে নিয়ে আমাদের প্রকৃতিকে নির্মল করে রাখছে।’

নূরুল ইসলাম শিশু বয়স থেকে বাবা ও মায়ের কাছ থেকে অসহায় দরিদ্রদের সাহায্য করা ও গাছ প্রকৃতির বন্ধু শুনে শুনে বড় হয়েছেন। সে আদর্শই হয়ে যায় তাঁর জীবনের পাথেয়
ছবি: প্রথম অালো

২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল। সকাল আটটা। ফরিদপুর শহরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সামনে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি। পাশে একটি ঝাঁকার মধ্যে বেশ কিছু প্যাকেট। সড়কে রিকশাচালকদের থামিয়ে তাঁদের হাতে তুলে দিচ্ছেন একটি করে প্যাকেট। যার মধ্যে ছিল ডিম, কলা, রুটিসহ সকালের নাশতা।

সেটাই ছিল নূরুল ইসলামের (৪৩) ভালো কাজের শুরু। তারপর কোনো মাসে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। নিজ উদ্যোগে প্রতি মাসে একটি ভালো কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। অতিমারি করোনার সময় জনজীবন যখন স্থবির হয়ে পড়ে, দিনের পর দিন ‘লকডাউন’, তখনো মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।

ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ টেপাখোলা লালের মোড় এলাকার বাসিন্দা ফকির আবদুর রহমান (৭৮) ও নূরজাহান বেগম (৬২) দম্পতির ছেলে নূরুল ইসলাম। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

নূরুল ইসলামের ভালো কাজগুলোর মধ্যে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে গাছ লাগানো, খাঁচা দিয়ে গাছ সংরক্ষণ করা, নিয়মিত পরিচর্যা করা। তাঁর মতে, ‘গাছ আমাদের পরম বন্ধু। নিঃস্বার্থভাবে আমাদের ফল দিয়ে, ফুল দিয়ে, প্রকৃতিতে অক্সিজেনের জোগান দিয়ে এবং ক্ষতিকর সব গ্যাস শুষে নিয়ে আমাদের প্রকৃতিকে নির্মল করে রাখছে।’

নূরুল ইসলাম রসায়ন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে বিএড ও এমএড করেন। বর্তমানে তিনি ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী শিক্ষক। তাঁর স্ত্রী শামীমা নাসরিন (৩২) গৃহিণী। এক মেয়ে ও এক ছেলের বাবা নূরুল ইসলাম। 

কেন নূরুল ইসলামের এ উদ্যোগ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিশু বয়স থেকে বাবা ও মায়ের কাছ থেকে অসহায় দরিদ্রদের সাহায্য করা ও গাছ প্রকৃতির বন্ধু শুনে শুনে বড় হয়েছেন। মা ও বাবার সেই শিক্ষা তাঁর মনে গেঁথে যায়। সে আদর্শই হয়ে যায় তাঁর জীবনের পাথেয়।

নিজের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে তিনি বলেন, তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন। শহরের তিতুমীর বাজার ও হাজি শরীয়তুল্লাহ কাঁচা বাজারসংলগ্ন কুমার নদের ওপর বেইলি সেতু দিয়ে বাবার সঙ্গে যাওয়ার সময় ভিক্ষুকদের দেখেন। এরপর পকেটে থাকা খুচরা পয়সা বিতরণ করা শুরু করেন। একপর্যায়ে ভিড়ে বাবাকে হারিয়ে ফেলেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর বাবা তাঁকে খুঁজে বের করেন। তখন বার্ষিক পরীক্ষার ফল ঘোষণার দিন স্কুল থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট দেওয়া হতো। তিনি সেই খাবার পথের অভুক্ত শিশুদের দিতেন।

স্কুলে থাকা অবস্থায় একদিন স্কুল থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে দেখতে পান, একজন দুস্থ ব্যক্তি ডাস্টবিন থেকে বিভিন্ন বাড়ির ফেলে দেওয়া পচা–বাসি খাবার খুঁটে খুঁটে খাচ্ছেন। নূরুল ইসলাম বলেছেন, ‘এ দৃশ্যটির কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না। সেই দিনই আমি আমার জীবনের কর্মপন্থা ঠিক করে ফেলি। জীবনে যখন প্রতিষ্ঠিত হব, নিজের বেতনের টাকার কিছু অংশ আমি প্রতি মাসে খরচ করব সমাজের গরিব–দুস্থ মানুষদের জন্য।’

রিকশাচালকদের মাঝে সকালের খাবার বিতরণের মধ্য দিয়ে নূরুল ইসলাম তাঁর সেবামূলক কাজ শুরু করেন। এরপর ২০১৯ সালের মে মাসে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৫০টি দুস্থ পরিবারের মাঝে দুধ, সেমাই, পোলাওয়ের চাল তুলে দেন। গত অক্টোবর প্রতিবন্ধী এক রিকশাচালককে মাসিক বাজার করে দিয়েছেন। এভাবেই চলছে তাঁর কাজ।

নানা সময়ে নূরুল ইসলাম নদীদূষণ রোধে ধলার মোড় পদ্মা নদীর পাড়ে এবং শহরের ভাটিলক্ষ্মীপুরের কোনায় পদ্মা নদীর শাখা কুমার নদের জলকপাট এলাকায় নোটিশ বোর্ড স্থাপন করেছেন। জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—বছরের এই চার মাস তিনি গাছ রোপণের ওপর জোর দেন। করোনাকালে আশপাশের দুস্থ ব্যক্তির বাড়িতে বাড়িতে বাজার পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছেন নিজের সাধ্য অনুযায়ী। এক মাসে ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী ও দুস্থ রিকশাচালকদের নিয়ে ফরিদপুরের একটি রেস্তোরাঁয় চায়নিজ খাইয়েছেন নূরুল ইসলাম। তিনি বলেনে, ‘চায়নিজ কেমন খাবার, কেমন স্বাদ তা এরা কখনো জানত না। তাই আমি চায়নিজ খাওয়ানোর উদ্যোগ নিই।’

নূরুল ইসলামের দেখাদেখি এসব কাজে এলাকার বেশ কয়েকজন তরুণ এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা নানাভাবে তাঁর কাজে সহযোগিতা করেন। তিনি বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার কাজে স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাশে রাখেন। 

নূরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এখন কাজ হচ্ছে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। প্লাস্টিক পণ্য বর্জন না করা পর্যন্ত মানবজাতি হিসেবে আমাদের মুক্তি নেই।’ 

চলার পথে সাহায্য যেমন পেয়েছেন তিনি, পাশাপাশি অনেকের কটুকথাও শুনেছেন। স্ত্রী প্রথমে তাঁর কর্মকাণ্ড ভালোভাবে নেননি, এখন তিনিই তাঁর সহযোগী হয়ে উঠেছেন।

মানবিক, আলোকিত মানুষ ছাড়া এ কাজ আর কেউ করেন না বলে মন্তব্য করলেন ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্র শেখর দাস। তিনি বলেন, নূরুল ইসলাম একজন আলোকিত মানুষ। বিদ্যালয়ে দক্ষতার সঙ্গে নিজের কাজ শেষ করে তিনি বাকি সময়ে এ কাজগুলো করছেন। তাঁর এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়।