পাশাপাশি বাঁশের ছোট আকারের দুটি ঘর। এসব ঘরে থাকে ৪০ জন শিক্ষার্থী। ঘরের বাইরে রয়েছে খাওয়াদাওয়া ও রান্না করার জায়গা। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের প্রেননৈ ছাত্রাবাসের চিত্র এটি। চিম্বুক পাহাড়ের রামরিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে এই ছাত্রাবাস, যেটিতে একসঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এবং ম্রো গানের তালিম দেওয়া হয়। ছাত্রাবাসটিতে কোনো কর্মচারী নেই। এর তত্ত্বাবধান, পাঠদান, রান্না করা, গান শেখানো—সবই করেন প্রেন প্রে ম্রো নামের এক তরুণ।
বিদ্যালয় ছুটি হলে প্রেন প্রে ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। ছুটির দিনে সবাইকে নিয়ে মেতে ওঠেন গানে। কখনো পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে গান ধরেন ‘আংক সিংরা হোং, আংক পয়রা হোং, আংক ইয়াং বং হোং (আমার জন্মভূমি পাহাড়/ আমার বেঁচে থাকার পাহাড়/ আমার ইয়াং বং হোং পাহাড়)।’
প্রেননৈ ছাত্রাবাসের বাঁশের ঘর দুটি তৈরি করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৪ জন ছাত্র ও ১৬ জন ছাত্রী।
ছাত্রাবাসে থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের পরিবারের পক্ষ থেকে ১৩ হাজার করে টাকা দেওয়ার কথা। তবে অনেক অভিভাবক সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেন না বলে দাবি প্রেন প্রে ম্রোর। এ অবস্থায় জেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদসহ নানা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করে সহায়তা নিতে হয় তাঁর। শাকসবজির চাহিদা মেটাতে চাষ করা হয় বিদ্যয়ের আশপাশে।
সম্প্রতি ছুটির দিনে রামরিপাড়া এলাকার ছাত্রাবাসটিতে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় বন্ধ হলেও শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসে রয়েছে। প্রেন প্রে বলেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বাড়ি দূরের বি ভিন্ন এলাকায়। তাই তাদের রেখে দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রাবাসে থাকা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র প্রেনসিং ম্রোর বাড়ি রুমা উপজেলার দুর্গম এলাকায়। সে বলে, ছাত্রাবাসে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া ও গান শেখা তার ভালো লাগে। তাই ছুটি পেলেও বাড়িতে যেতে সব সময় ইচ্ছা হয় না। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী য়ারুই ম্রো বলে, তার বাড়ি থানচিতে। একবার যাতায়াত করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। তাই বাড়িতে কম যেতে চায় সে। পাহাড়ধসে বাবা মারা যাওয়ার পর ছাত্রাবাসই তার ঘরবাড়ি বলে জানায় দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র পাসিং ম্রো।
ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পড়ালেখা আর গানে মেতে থেকে নিজেও বেশ আনন্দ পান বলে জানালেন প্রেন প্রে ম্রো। চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো জীবন-জীবিকা, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনা ও প্রকৃতি নিয়ে তিনি এ পর্যন্ত ২৭টি গান লিখেছেন। এসব গানের সুর দিয়ে নিজেই গেয়েছেন। তাঁর গান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছে।
ছাত্রাবাস পরিচালনা নিয়ে প্রেন প্রে ম্রোর প্রশংসা করে লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো বলেন, প্রেন প্রে ম্রো ছাত্রাবাসটি ঘিরে একটি জগৎ গড়ে তুলেছেন। তিনি না হলে ছাত্রাবাসটি অচল হয়ে পড়বে।
জেলা পরিষদের সদস্য সিংয়ং ম্রো বলেন, প্রেন প্রে ম্রোর ত্যাগ ও আন্তরিকতা দেখে ছাত্রাবাসের জন্য অনেকে সহযোগিতা করেন। জেলা পরিষদ ও টংকাবতী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা হয়। প্রেন প্রের ম্রো গানের চর্চা ও শেখানোর আগ্রহ দেখে তিনি নিজে ছাত্রাবাসে গিটার, কি-বোর্ড, হারমোনিয়াম ও তবলা দিয়েছেন।
সিংয়ং ম্রো বলেন, ম্রো পাড়ায় বিদ্যালয় খুব কম। তাই শিক্ষা বিস্তারে প্রেন প্রে ম্রোদের মতো ত্যাগ স্বীকার করা তরুণদের খুব প্রয়োজন।