‘জীবনে অনেক জানাজা পড়াইছি, মেয়ের জানাজা পড়াইতে হবে স্বপ্নেও ভাবি নাই’
জীবনে কতবার জানাজা পড়িয়েছেন মনে করতে পারেন না মাদ্রাসাশিক্ষক ও মসজিদের ইমাম জাহেদুল ইসলাম তালুকদার। কিন্তু গতকাল সোমবার মসজিদের মাঠে তিনি যে জানাজা পড়ালেন, সেটি ছিল তাঁর জীবনের নিষ্ঠুরতম। যার জানাজা পড়াচ্ছিলেন তিনি, সে যে তারই বুকের ধন, একমাত্র মেয়ে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নাজিরহাট পৌরসভার বেতুয়ারকুল গ্রামে বাড়ির নিচতলায় দেখা তাঁর সঙ্গে। ঘরের একটা সোফায় বসে ছিলেন তিনি। হালকা–পাতলা গড়নের মানুষটি ভেজা চোখে তাকিয়েছিলেন একদিকে।
কাছে যেতেই জাহেদুল বললেন, ‘বারবার চেষ্টা করেও আমার মুখ দিয়ে জানাজার নিয়ত, দোয়া আসতেছিল না। বাক্শক্তিহীন হয়ে পড়ছি। জীবনে অনেক মানুষের জানাজার নামাজ পড়াইছি। কিন্তু আমার ছোট্ট মেয়ের জানাজা আমাকে পড়াইতে হবে স্বপ্নেও ভাবি নাই। যখন কয়েক হাজার মুসল্লির সামনে আমি জানাজার নিয়ত করতে যাই, তখন আমার মুখ দিয়ে কিছুই আসতেছিল না। দোয়াটা আমার মুখ দিয়ে আসতেছিল না। তিনবার করে আমাকে দোয়া পড়ইতে হয়।’ এটুকু বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের স্কুলের গেটে ঢোকার সময় জাহেদুলের মেয়ে আইনুর তাজফিকে চাপা দেয় একটি জিপ (চাঁদের গাড়ি)। এ ঘটনায় আইনুর ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বেপরোয়া ওই চাঁদের গাড়িটি আইনুর ছাড়াও তিন শিক্ষার্থীকে পেছন থেকে চাপা দিয়েছিল। আহত অপর শিক্ষার্থীরা হলো মুফতারিন জাহান (৭), মায়শা মনি (৯) ও মেঘলা দেবী (৮)। তাঁরা সবাই সুয়াবিল ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ওই স্কুলের। নিহত আইনুরের দাদা ছিলেন ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা।
এত সুন্দর হাতের লেখা
নাজিরহাট পৌরসভার বেতুয়ারকুল গ্রামে আইনুরদের বাড়িতে আজ দুপুরে ছিল স্বজন ও প্রতিবেশীদের ভিড়। বাড়ির বাইরেও চেয়ার পেতে দেওয়া হয়েছে। সবাই বাড়ির ভেতরে এসে একে একে দেখা করে যাচ্ছেন আইনুরের মা–বাবার সঙ্গে।
ঘরের একটা টেবিলে এখনো ছড়িয়ে আছে আইনুরের খাতা, রংপেনসিলের বক্স আর বই। একেকটি খাতায় আইনুরের আঁকা ছবি। আইনুরের মা ইসমত আরা একটা খাতা দেখিয়ে বললেন, ‘দেখেন, কী সুন্দর হাতের লেখা আমার মেয়ের। ক্লাস থ্রির বাচ্চার হাতের লেখা কখনো এমন হয়? দেখলে মনে হবে কোনো কলেজে পড়া মেয়ের লেখা।’
আইনুরের খাতা ধরে মা আর কিছু বলতে পারলেন না। মেয়ের কৃতিত্বের গর্ব নয়, বরং শোক তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন, কেউ একজন এসে ধরলেন তাঁকে।
দোতলা বাড়িটির সিঁড়িঘরটায় অনেকগুলো তাক। সেখানে আইনুরের খেলনা সাজানো। পুতুল থেকে শুরু করে খেলনার ডেকচি-পাতিল সবই যেন খেলনার মালিকের অপেক্ষায়।
কখনো দ্বিতীয় হয়নি আইনুর
প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত আইনুর কোনো ক্লাসেই দ্বিতীয় হয়নি। প্রতিটি ক্লাসেই প্রথম হয়েছে সে। রোল নম্বর ১ ছিল তার জন্য বরাদ্দ। স্কুলেও সব শিক্ষকের আদরের ছিল সে।
সুয়াবিল ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওসমান গণি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত ভালো মেধাবী মেয়েটিকে এভাবে হারিয়ে আমরা শোকে পাথর। সে প্রতিটা শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। স্কুল এলাকায় চাঁদের গাড়ি চাপার ঘটনার বিচার চাই আমরা।’
আইনুরের মা ইসমত আরার অনেক স্বপ্ন ছিল মেয়েকে ঘিরে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার সব স্বপ্ন ছিল মেয়েটিকে ঘিরে। অনেক মেধাবী ছিল সে। শিশু বয়স থেকেই স্কুলের পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পুরস্কার পেত। আমাদের বলত, বড় হলে শিক্ষক নয়তো চিকিৎসক হবে সে। আমার ছেলেটি প্রতিবন্ধী। তাই মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব।’
অনেক সাধনার ধন
আইনুরের বাবা জাহেদুল ইসলাম তালুকদার (৪৫) ও মা ইসমত আরার (৩০) প্রথম সন্তান হয় ২০০৯ সালে। সেই সন্তান জন্মের এক সপ্তাহ পর রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর দুই বছর পর ২০১১ সালে তাঁদের কোলে আসে আরেক ছেলে সন্তান আহমেদ তকি তালুকদার। তবে তকি জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার। সপ্তম শ্রেণিতে পড়লেও এখনো অনেকটাই নির্ভরশীল জীবনযাপন তকির। ২০১৪ সালে জন্ম হয় আইনুরের। পাঁচ বছর বয়সে তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা দাদা নুরুল ইসলাম তালুকদারের প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় সুয়াবিল ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
ছবি আঁকা থেকে শুরু করে লেখাপড়া—সব দিকেই সমান আগ্রহ ছিল আইনুরের। আইনুরের দাদা ছিলেন শিক্ষানুরাগী। এই এলাকার প্রথম উচ্চশিক্ষিতদের একজন তিনি। আইনুরও তার দাদার মতো পরিবারের নাম ছড়াবে, এই বিশ্বাস ছিল মা-বাবার।
নাজিরহাটের সুয়াবিল ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এখনো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ রয়ে গেছে। ঘাসের ওপর পড়ে রয়েছে আইনুরের একটি স্পঞ্জের স্যান্ডেল। পাশের একটি মাদ্রাসার মাঠে ঘাতক চাঁদের গাড়িটি পার্ক করা রয়েছে। আজ বেলা ১১টায় সেখানে মানুষের ভিড়। শিক্ষার্থীদের স্কুলের গেটে চাপা দেওয়ার বিষয়টি মানতে পারছেন না কেউ। ক্ষুব্ধ অভিভাবক ও এলাকাবাসী এ ঘটনার দ্রুত বিচার চান।
ঘটনাস্থলের ১০০ ফুট দূরে তার স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন শ্রেণিশিক্ষক। তবে আইনুরের বসার আসনটি এখনো ফাঁকা। সেদিকে তাকিয়ে শিক্ষক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ক্লাসে তখন রাজ্যের নীরবতা। সবাই যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।