বরিশাল সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগে যে অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছিল, তাতে কিছুটা ‘স্বস্তি’ এনেছে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের পর। কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে গত বুধবার ওই কমিটি গঠন করে আওয়ামী লীগ।
কমিটি গঠনের পর বরিশালে আওয়ামী লীগের উভয় পক্ষ এটিকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করলেও বিভেদের বরফ গলার আলামত এখনো দেখা যায়নি। দূরে থাকা নেতারা আজ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত দলীয় প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর পাশে দাঁড়াননি এবং যোগাযোগও করেননি।
এই কমিটি প্রকাশের পর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সমর্থক নেতারা অনেকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে দলের এমন সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন। অন্যদিকে মেয়র পদপ্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর সমর্থক নেতারাও দলে ঐক্য ফেরাতে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। তবে এতে দুপক্ষের মধ্যে যে বিভেদ ও অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে, তা কতটা নিরসন হবে, এ নিয়ে ভেতরে-ভেতরে শঙ্কা আছে।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁর ছোট চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। এতে শুরু থেকেই সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে থাকা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিলেন।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বরিশালে আসবেন। এরপর যৌথসভা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা মাঠে নামব।’ তবে তিনি কবে নাগাদ আসবেন, তা সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি এই নেতা।
বুধবার কেন্দ্র থেকে নতুন ওই কমিটি ঘোষণার পর সবাই আশা করেছিলেন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর ছেলে বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থক বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামবেন। একইভাবে তাঁদের অনুসারী নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীরাও প্রকাশ্যে দলীয় মেয়র পদপ্রার্থীর পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু পরিস্থিতি আজ সকাল পর্যন্ত মোটেই পাল্টেনি।
ওয়ার্ড নেতাদের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নামার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘না, আমরা এখনো কোনো নির্দেশনা দিইনি। যৌথসভার পরে দেব। কেননা, আমরা দলীয় কাঠামোর মধ্য দিয়েই সব সিদ্ধান্ত নিতে চাই। আচরণবিধি যাতে লঙ্ঘিত না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই যা করার, করা হবে।’
আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ বরিশালের রাজনীতিতে যে শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করেছেন, তা ঠিক করতে হলে তাঁদেরই প্রয়োজন হবে। কমিটি গঠনের পর এখন তাঁদের হৃদয়ের সংস্পর্শ কতটা পাওয়া যাবে এবং তাঁরা কতটা আন্তরিকতা নিয়ে নির্বাচনে কাজ করবেন, সেটা বুঝতে হলে আরও সময় লাগবে।মীর আমিন উদ্দীন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁর ছোট চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। এতে শুরু থেকেই সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে থাকা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিলেন। এই নির্লিপ্ততা শেষ পর্যন্ত দলের মধ্যে বিভেদ এবং পরে তা সংঘাতে রূপ নেয়। গত ১৫ এপ্রিল দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাদিক আবদুল্লাহ আর বরিশালে আসেননি। তাঁরা ঢাকায় অবস্থান করছেন। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে বুধবার কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয় কেন্দ্র। এর প্রধান করা হয় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে।
বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মীর আমিন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই কমিটি গঠনের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই আপাতত দেখছি। তবে তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।’ তিনি আরও বলেন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ বরিশালের রাজনীতিতে যে শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করেছেন, তা ঠিক করতে হলে তাঁদেরই প্রয়োজন হবে। কমিটি গঠনের পর এখন তাঁদের হৃদয়ের সংস্পর্শ কতটা পাওয়া যাবে এবং তাঁরা কতটা আন্তরিকতা নিয়ে নির্বাচনে কাজ করবেন, সেটা বুঝতে হলে আরও সময় লাগবে।
আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, মনোনয়ন ঘোষণার তিন দিন পর ১৮ এপ্রিল নীরবতা ভেঙে খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন মনোনয়নবঞ্চিত সাদিক আবদুল্লাহ। তিনি ঢাকা থেকে ভার্চ্যুয়ালি নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীদের নিয়ে কাজ করার ঘোষণা দেন। তবে গত এক মাসেও সেই ঘোষণার প্রতিফলন দেখা যায়নি। এক মাস ধরে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ নগরের বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাবেক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করলেও মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের তাঁর সঙ্গে দেখা যায়নি। এরপর নগরে মে দিবসে এবং বুধবার প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে উভয় পক্ষ। এমনকি আবুল খায়েরের সমর্থকদের ওপর দুটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে মামলাও হয়েছে। নগর ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়কসহ ১৪ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে। এ ঘটনার জেরে নগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। হুমকি দেওয়ার ঘটনায় দুটি জিডি হয়েছে।
এমন ঘটনার পর বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যে উত্তাপ ছড়িয়েছে, তা নিরসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে ওঠে। কিন্তু বুধবার রাতে দ্বন্দ্ব নিরসনে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে।
দ্বন্দ্ব-সংঘাত যারা সৃষ্টি করছে, তারা একটি বিশেষ পক্ষ। তাদের মূল উদ্দেশ্য দলের মধ্যে একটি বিভেদ সৃষ্টি করা। তারা চাইছে, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে বরিশালের রাজনীতি থেকে উৎখাত করবে, কিন্তু এটা অসম্ভব ব্যাপার।
জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আফজালুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেসবুকে আমরা কমিটি দেখেছি। এখনো অফিশিয়ালি চিঠি পাইনি, তবে এটা অথেনটিক ও ইতিবাচক। তবে আমরা এখন ১২৬টি কেন্দ্রের কমিটি, ওয়ার্ডগুলোয় নির্বাচনী অফিস, প্রার্থীর সভাগুলো যথাযথভাবে করা নিয়েই ব্যস্ত। তবে আমাদের সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন, নৌকার বিজয়। কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁদের মতো করে কাজ করবেন। আমরা মাঠে কাজ করছি। তবে গতকাল পর্যন্ত জেলা, নগর ও ওয়ার্ডের নেতারা নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত হননি এবং আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেননি।’
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বরিশালের রাজনীতিতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর প্রভাবের কারণে তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর সাদিক আবদুল্লাহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে মহানগর আওয়ামী লীগ থেকে প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণপন্থী নেতা-কর্মীরা ছিটকে পড়েন। নিজের লোকদের নিয়ে মহানগর ও ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন করে সাদিক আবদুল্লাহ নিজের প্রভাববলয় তৈরি করেন বলে অভিযোগ আছে। বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক মন্ত্রিত্ব পেলেও সাদিক আবদুল্লাহর প্রভাবে দলে ছিলেন কোণঠাসা। ছিটকে পড়া প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের সমর্থক নেতা-কর্মী ও পুরোনা নেতারা পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে ঘিরে আলাদা বলয় তৈরি করলেও তাঁরা এত দিন নীরব ছিলেন। খায়ের আবদুল্লাহ মনোনয়ন পাওয়ার পর তাঁরা নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর পক্ষে নেমেছেন।
দলের নেতাদের নির্লিপ্ততা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে দলটির জাতীয় কমিটির সদস্য গোলাম আব্বাস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটা বিষয়ই একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়। যাঁরা দলের নেতৃত্ব দেন, তাঁদের যথাযথ সম্মান, মর্যাদা নিশ্চিত না করা হলে সেটাও অবমাননাকর বিষয়ে পরিণত হয়। আমরা বলিনি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে যাব না, কিংবা আমাদের নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বলেননি, তিনি আসবেন না। আমি বারবারই বলেছি, তিনি বরিশালে যাবেন।’ তিনি বলেন, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত যারা সৃষ্টি করছে, তারা একটি বিশেষ পক্ষ। তাদের মূল উদ্দেশ্য দলের মধ্যে একটি বিভেদ সৃষ্টি করা। তারা চাইছে, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে বরিশালের রাজনীতি থেকে উৎখাত করবে, কিন্তু এটা অসম্ভব ব্যাপার।