৩ বন্ধু ছিলেন, বেঁচে ফিরলেন শুধু সাদ

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অরেঞ্জ ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন সাদ মাহমুদছবি: প্রথম আলো

‘আগুন লেগেছে টের পাওয়ার পর আমরা তিন বন্ধু একসঙ্গে দৌড়ে বের হই। ধোঁয়া, হইচই, চিৎকার চারপাশে। একদল সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। একদল নিচে নামার চেষ্টা করছে। আমরা তিনজন ওপরের দিকে ছুটি। কিন্তু ওপরের ফ্লোরে (তলা) পৌঁছে পেছনে ঘুরে দেখি ওরা নেই,’ কথাগুলো বলছিলেন সাদ মাহমুদ (২৩)। তিনি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অরেঞ্জ ইউনিটে ভর্তি আছেন। আজ শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে হাসপাতালে তাঁর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
বেঁচে থাকাটা এখনো সাদের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। ভবনের নিচে উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনেরা ফোন করে তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওপরে যাও, ওখানে রেসকিউ (উদ্ধার) হচ্ছে।’ সঙ্গে থাকা দুই বন্ধু স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে বার কাউন্সিলের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া জুনায়েদ হক ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নাজমুল আহসান মারা গেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে বহুতল ভবনের নিচতলা থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়লে মারা যান ৪৬ জন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাদসহ ১১ জন অরেঞ্জ ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার এলাকার বাসিন্দা সাদ মাহমুদ রাজধানীর ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) বিবিএর ছাত্র। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। বাবা মাহমুদ আলী পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী। মায়ের নাম রেহানা মাহমুদ। ঘটনার পরপর গতকাল রাতে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে যাওয়ার পর শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সাদের। পরে দিবাগত রাত একটায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখন শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাদ মাহমুদ বলেন, তাঁরা চার বন্ধু খেতে গিয়েছিলেন ওই ভবনের চারতলায় খানা’স নামের একটি রেস্তোরাঁয়। কাজ থাকায় সিয়াম আহমেদ নামের এক বন্ধু আগেভাগেই বেরিয়ে যান। তিন বন্ধু খাচ্ছিলেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে আগুন লাগার বিষয়টি তাঁরা টের পান। রেস্তোরাঁ থেকে বের হতে গিয়ে দেখেন, সিঁড়ির নিচ থেকে কালো ধোঁয়া দলা পাকিয়ে উপরের দিকে উঠছে। তখন তাঁরা ওপরে ছাদের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন অনেকে চিৎকার করতে করতে নিচের দিকে নামছিলেন। কেউ হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে সিঁড়িতে পড়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা তিন বন্ধুকে ওপরে যেতে মানা করেন। লোকজন বলছিলেন, ছাদের দরজা বন্ধ থাকতে পারে। সেই সময় নিচ থেকেও একদল ওপরের দিকে উঠে আসছিলেন। সবকিছুই মুহূর্তের মধ্যে ঘটছিল।

রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া বহুতল ভবন। আজ শুক্রবার সকালে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

সাদ বললেন, ‘ওই সময় আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকি। পঞ্চম তলায় ওঠার পর পেছনে ঘুরে দেখি ওরা (জুনায়েদ, নাজমুল) নেই। ওই ফ্লোরে তখন ৪০ থেকে ৫০ জনের মতো লোক। কয়েকজন মিলে থাই গ্লাস ভেঙে ফেলেন। তখন কালো ধোঁয়া ঢুকে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়।’ সাদ জানান, তিনি ওই ফ্লোরের রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ান। রুমাল ভিজিয়ে বারবার মুখ মুছতে থাকেন। পরনের গেঞ্জি খুলে ভিজিয়ে আবার গায়ে পরে নেন। কিন্তু এরপরও দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তাঁর পরিবারের লোকজন ততক্ষণে খবর পেয়ে ভবনের নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা ফোন করে সাদকে বলেন, ‘ওপরে যাও, ওখানে রেসকিউ (উদ্ধার) হচ্ছে।’ সাদ বলেন, ‘কিচেন থেকে বের হতেই পারছিলাম না ঘন ধোঁয়ায়। ওদের বললাম, কিছুতেই বের হওয়া সম্ভব নয়। ৩০ মিনিট পর বাসার লোকজন ফোন করে জানালো, আমি যেন কোনো রকমে ওই ফ্লোরের খোলা একটি অংশে গিয়ে দাঁড়াই। ওখানে ফায়ার সার্ভিস ল্যাডার (মই) লাগিয়েছে।’এরপর তিনি নাকে ভেজা রুমাল চেপে আরও অনেকের মতো নিচের দিকে ঝুঁকে দৌড়ে বহু কষ্টে অন্য পাশে এসে দাঁড়ান। মই বেয়ে নেমে আসেন। সাদ বলেন, ‘ভবনটি খুব সরু। পেছনে আলাদা করে কোনো জরুরি অগ্নিনির্গমন পথ (ফায়ার এক্সিট) নেই।’

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অরেঞ্জ ইউনিটের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাস প্রথম আলোকে বলেন, বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রাতে যে ১০ জন মৃত ব্যক্তিকে পাওয়া গেছে, তাঁদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাঁরা আগুনে না পুড়লেও বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এই ইউনিটে চিকিৎসাধীন ১১ জনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, তাঁদের নিশ্বাসের সঙ্গে কার্বন মনোক্সাইড দেহে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে কেউ কেউ বাঁচার জন্য ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন।