দুই প্রার্থীর মধ্যে উত্তেজনা, ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা 

আসনটিতে শুরু থেকেই আলোচনায় মমতাজ বেগম ও দেওয়ান জাহিদ আহম্মেদ। মারমুখী অবস্থানে দুই প্রার্থীর সমর্থকেরা।

মমতাজ বেগম ও দেওয়ান জাহিদ আহম্মেদ

এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জে তিনটি আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা ছড়িয়েছে মানিকগঞ্জ-২ (সিঙ্গাইর-হরিরামপুর-সদরের একাংশ) আসনে। আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মমতাজ বেগম এবং দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহম্মেদের অনুসারীদের মধ্যে হুমকি, সংঘর্ষ, নির্বাচনী ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ এবং একাধিক মামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ভোটারদের ধারণা, ভোটের দিন ছড়াতে পারে নির্বাচনী সহিংসতা। সুষ্ঠু ভোট নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁরা।

 মানিকগঞ্জ জেলার মধ্যে এই আসনে সবচেয়ে বেশি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা অতিগুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আসনটিতে ভোটকেন্দ্র ১৯৩টি। এর মধ্যে ৮০টি কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। হরিরামপুরের বয়রা ইউনিয়নের ভোটার ফরিদ হোসেন বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণায় প্রার্থীরা ও তাঁদের লোকজন বিভিন্ন কথা বলছেন। কেন্দ্রে মারামারি, হানাহানি হলে সমস্যা। মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়া কেন্দ্রে যামু। যদি কেন্দ্রে মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি হয়, তা নিয়া শঙ্কায় আছি।’

দলীয় মনোনয়ন চাওয়ার সময় থেকেই আসনটিতে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। দল বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমকে বেছে নেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগেরই আরও চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। তাঁরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান জাহিদ আহম্মেদ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান সফিউল আরেফিন (টুটুল), জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মুশফিকুর রহমান খান ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য সাহাবুদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া বিভিন্ন দলের আরও ছয়জন প্রার্থী রয়েছেন।

এর মধ্যে শুরু থেকেই বেশি আলোচনায় মমতাজ বেগম ও জাহিদ আহম্মেদ। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেন। নির্বাচনে দেওয়ান জাহিদের প্রতীক ট্রাক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৫ ডিসেম্বর বিকেলে হরিরামপুর উপজেলা সদরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মমতাজ বেগমের অনুসারীরা জাহিদ আহম্মেদের সমর্থকদের ওপর হামলা করেন। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর তিন কর্মী আহত হন। তাঁদের মধ্যে একজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ নিয়ে দুই প্রার্থীর কর্মী–সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর পরের দিন ভোরে সিঙ্গাইর উপজেলার সায়েস্তা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচনী অস্থায়ী ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করা হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীরা এই অগ্নিসংযোগ করেন বলে নৌকার প্রার্থীর অভিযোগ।

এরপর সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থক অনুসারীদের মধে্য উত্তেজনা  আরও বাড়ে। প্রচারের সময় আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সহিংসতার ঘটনায় হরিরামপুর ও সিঙ্গাইর থানায় ছয়টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ান জাহিদের চারজন অনুসারী হরিরামপুর থানায় চারটি মামলা এবং সিঙ্গাইর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা একটি মামলা করেছেন। এসব মামলায় মমতাজ বেগমের কর্মীদের আসামি করা হয়েছে। একটি মামলা করেছেন নৌকা প্রার্থীর অনুসারী এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আবিদ হাসান। এই মামলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদের অনুসারীদের আসামি করা হয়েছে।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার প্রচারণার শেষ দিনে ওই দুই প্রার্থীই সংবাদ সম্মেলন করে একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন। 

গত এক সপ্তাহে এই আসনের বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশতাধিক ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মমতাজ বেগম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদের কর্মীদের মধ্যকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ক্রমেই বাড়ছে। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, দুই প্রার্থীর কর্মী ও সমর্থকেরা আরও মারমুখী হয়ে উঠছেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মমতাজ বেগমের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সিঙ্গাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, টাকাপয়সা ও মালামাল দিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে আসছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর (দেওয়ান জাহিদ আহম্মেদ) লোকজন। তাঁরাই নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করছেন।

পাল্টা দাবি স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহম্মেদের অনুসারী ও সিঙ্গাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েদুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর দেখে নেবে বলে নৌকার প্রার্থীর কর্মীরা আমাদের কর্মী ও ভোটারদের হুমকি–ধমকি দিচ্ছে। বিভিন্ন কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করবে নৌকার কর্মীরা।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এই আসনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করেছে। এসব কেন্দ্র নিয়ে রয়েছে তাদের বাড়তি প্রস্তুতি। জেলা প্রশাসক এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা রেহেনা আকতার বলেন, অধিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের টহল জোরদার থাকবে।