ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম ৭৬ টাকা কমলেও বরিশালের বাজারে তার প্রভাব নেই। দাম কমার পর ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের মূল্য ভোক্তা পর্যায়ে ১ হাজার ৪২২ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বরিশালে ১ হাজার ৫২০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায় খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে। আজ শনিবার বরিশালের বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, দাম কমার পর নতুন দামের চালান এখনো বরিশালে না আসায় বাজারে এর প্রভাব পড়েনি।
তবে অনেক ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, যখন দাম বাড়ে, তখন তা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায়। কিন্তু যখন দু-চার টাকা কমে, তখন তা কমতে সপ্তাহ, মাস পার হয়ে যায়। এখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। দাম কমার পর দোকানগুলোয় গ্যাস নেই। বাড়িত দাম দিলে পাওয়া যায়। ব্যবসায়ীরা গ্যাস মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা করতেই এমনটা করছেন। বাজার তদারকি না থাকায় এর মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে ক্রেতাদের নানা অভিযোগ শোনা গেছে। নগরের বাংলাবাজারে গ্যাস কিনতে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক চাকরিজীবী জুবায়ের হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তিনি তাঁর পাঁচ সদস্যের সংসারের এখন ব্যয় সংকুলান করতে পারছেন না। মাছ-মাংসের গায়ে হাত লাগানো যায় না। ব্রয়লার মুরগি ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি। চাষের পাঙাশ মাছের কেজি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পুষ্টির জোগান দিত এত দিন এই মাছ ও মাংস। কিন্তু তা–ও এখন সাধ্যের বাইরে। এর মধ্যে আজ সকালে গ্যাস কিনতে গিয়ে দাম শুনে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ে।
কয়েক দোকান ঘুরে দাম যাচাই করে দেখেছেন ১ হাজার ৫৫০ টাকার নিচে কোনো গ্যাস নেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সরকার বলে গ্যাসের দাম কমাইছে, কই কোনো কিছুই তো নড়চড় হয়নি? এটা জনগণের সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কী?’
নগরের বটতলা বাজারের আকন স্টোর, আলম স্টোর, জামান স্টোর—তিনটি দোকান ঘুরে জানা যায়, সব কোম্পানির গ্যাসের দামই ১ হাজার ৫৫০ টাকা। আকন স্টোরের মালিক মাহতাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রতি সিলিন্ডার ৫০ টাকা লাভে বিক্রি করি। তা–ও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাই না। ১ হাজার ৫৫০ টাকায় পাইকারি কিনি, ১ হাজার ৬০০ টাকায়ই বেচি। পাইকারি বাজারে বাড়ালে আমাদের তো কিছু করার নেই।’
নগরের বাংলাবাজারে গিয়ে কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে কোম্পানিভেদে নানা দামে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে। আপন স্টোরে লাফস গ্যাসের সিলিন্ডার ১ হাজার ৫২০ থেকে ১ হাজার ৫৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাবাজারের আরেকটি দোকানের মালিক মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা ১০০ সিলিন্ডার চাইলে ডিলাররা দেন ২০টা। বর্ধিত দাম গুনেও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছি না। ক্রেতারা আমাদের দোষে, প্রতিদিনই বচসা হয়। আমরা নিরুপায়।’ সেখানে কথা হয় ফ্রেস কোম্পানির ডিলারের এক প্রতিনিধির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা পাইকারি বাজারে ১ হাজার ৪৬০ টাকায় গ্যাস বিক্রি করি। এখন খুচরা বাজারের কারা, কত টাকায় বিক্রি করে, সেটা আমাদের জানা নেই।’
বাংলাবাজার এলাকায় কথা হয় নগরের কালুশাহ সড়কের বাসিন্দা মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, মহল্লায় একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল তাঁর। কিন্তু গ্যাস ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য এত বেড়েছে যে বাধ্য হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। তাই বেচাবিক্রিও অর্ধেকের চেয়ে কমে গিয়েছিল। তার মধ্যে আবার বাকির খাতা ভারী হওয়ায় পুঁজি হারাচ্ছিলেন তিনি। মিজানুর বলেন, ‘আমাদের আর বাঁচার মতো অবস্থা নেই। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষের সবচেয়ে টান পড়েছে পরিবারের দৈনন্দিন খাবারে।’
গ্যাসের বাজারে নৈরাজ্য ও নিত্যপণ্যের মূল্য অসহনীয় হওয়ায় বাজার মানুষের জীবন যে পদে পদে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, তা টের পাওয়া গেল নগরের প্রোর্ট রোড বাজারে গিয়ে। সেখানে কথা হয় নগরের একটি ব্যাংকের কর্মচারী মাইনুল ইসলামের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকার আর কোনো পথ দেখছি না। আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। বাজারে এলে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বরিশালের সাধারণ সম্পাদক রনজিৎ দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাসের দাম সিলিন্ডারে ৭৬ টাকা কমলেও এখানে তা কমেনি। ব্যবসায়ীরা দোহাই দিচ্ছে, নতুন চালান আসেনি। কিন্তু গত মাসের প্রথম দিকে যখন দাম বাড়ানো হয়েছিল, তখন তো সঙ্গে সঙ্গেই বেড়ে গিয়েছিল। তাহলে এখন কমাতে গিয়ে দেরি হচ্ছে কেন? বাজার তদারকি না থাকায় এমনটা হচ্ছে।’
পরিবেশকেরা অতিরিক্ত দাম দিয়ে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে গ্যাস কিনছে। এ জন্য ভোক্তা পর্যায়ে দামে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন বরিশাল জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সুমী রানী মিত্র। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাজার তদারক করে দেখেছি, গ্যাসের অধিক দামের বিষয়টি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কারসাজি নয়, বরং তাঁরা কোম্পানির কাছ থেকে অতিরিক্ত দামে গ্যাস কিনছেন। এ জন্য গোড়া থেকে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মাঠপর্যায়ে এর সুফল মিলবে না। তারপরও আমরা অভিযানে গিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্যাশমেমো যাচাই করি। অতিরিক্ত মুনাফা না করার পরামর্শ দিই।’