হাওরের জলে-ঢেউয়ে বাঁধা জীবন
দূর থেকে মনে হয় ছোট্ট কোনো দ্বীপ। চারদিক জলে ঘেরা। যেন থই থই জলের ওপর ভাসছে গ্রামটি। গ্রামটিতে নেই কোনো রাস্তাঘাট। শিশুদের পড়ার কোনো পাঠশালাও নেই। ভরা বর্ষায় যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা। এখানে মানুষের জীবন হাওরের জলে, উথালপাতাল ঢেউয়ের ছকে বাঁধা।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় থাকা এই গ্রামের নাম আলমপুর। উপজেলা সদর থেকে নৌকায় যেতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগে। হাওরের অন্য গ্রামের মতো এই গ্রামেও বছরের ছয় মাস জলবন্দী জীবন কাটে মানুষের। পুবে-পশ্চিমে লম্বালম্বি এই গ্রামের ছোট ছোট ঘরগুলো টিনের। কোনোটির চালা টিনের হলেও বেড়া খড়ের। ঘরগুলো দেখেই বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থার আন্দাজ পাওয়া যায়। জেলে-কৃষক পরিবার। বসতভিটার সামনে-পিছে বাঁশের আড় দিয়ে বাঁধা। আড়ের ভেতর মাটিভর্তি বস্তা অথবা চাইল্যা বন। কোথাও কোথাও দেওয়া হয়েছে পাথর। হাওরের ‘আফাল’ থেকে ঘরবাড়ি, বসতভিটা রক্ষা করতেই এই প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা। হাওরের গ্রামগুলোতে যুগ যুগ ধরেই মানুষ নিজেদের বসতভিটা রক্ষায় প্রতিবছর এই কাজ করে থাকেন। সংসার চলুক আর না চলুক, এই কাজ তাঁদের করতেই হয়।
বর্ষায় জলভরা হাওরের ঢেউ এসব গ্রামের মানুষের কাছে স্বাভাবিক বিষয় হলেও ‘আফাল’ নিয়ে যত ভয় তাঁদের। দমকা হাওয়া কিংবা ঝড়ের সময় উত্তাল হাওরে যে বড় বড় ঢেউ ওঠে, এ জনপদের মানুষ সেটিকে বলে ‘আফাল’। তখন বসতভিটা, ঘরবাড়ি ও জীবন রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রতিবছর বৈশাখ মাসে হাওরের ধান তুলেই মানুষের প্রথম কাজ হচ্ছে আফাল থেকে ঘরবাড়ি রক্ষায় বসতভিটার পাশে আড় দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা। এটি করতেই হবে। টাকাপয়সা না থাকলে ঋণ করে হলেও এটি করেন হাওরপাড়ের মানুষেরা। কোনো কোনো বছর বন্যা একাধিকবার হলে বসতভিটা রক্ষার এই কাজটিও একাধিকবার করতে হয়। এতে বড় বিপদে পড়েন হাওরের দরিদ্র কৃষক-জেলে পরিবারের লোকজন।
আলমপুর গ্রামটি বিশাল-বিস্তীর্ণ টাঙ্গুয়ার হাওরের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। গ্রামের লোকজন শুকনা মৌসুমে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। আর বর্ষায় হাওরে মাছ ধরে জীবন চালান।
গ্রামের বাসিন্দা জামাল উদ্দিন (৪৮) বলেন, আষাঢ় থেকে ভাদ্র—এই তিন মাস হাওরে পানি থাকে বেশি। ঢেউ থেকে বসতভিটা রক্ষায় প্রতিবছর চারপাশে বাঁশ দিয়ে আড় দিতে হয়। এ কাজে এবার তাঁর ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার টাকা। কিন্তু বন্যায় ঘর ও আড় দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার কীভাবে মেরামত করবেন, টাকা কোত্থেকে পাবেন—এই নিয়ে চিন্তায় আছেন।
জামাল উদ্দিনের স্ত্রী সাফিয়া বেগম জানান, গ্রামে কোনো স্কুল নেই। ২০ থেকে ২৫ জন ছেলেমেয়ে পাশের গ্রামের স্কুলে গিয়ে পড়ে। বর্ষায় নৌকাই ভরসা। অনেকের নৌকা নেই, তাই বাচ্চারা স্কুলে যায় না। আবার যেদিন হাওরে ঢেউ বেশি থাকে, সেদিন বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো হয় না।
দিলরুবা বেগমের (৩৫) ঘরটি গ্রামের একেবারে পশ্চিম মাথায়। ঘরের পাশে দেওয়া আড় ভেঙে গেছে। দিলরুবা বলেন, ‘ঢেউয়ের ধাক্কা এই অবস্থা করেছে। ভাত খাওয়ার উপায় নাই, মেরামত করব কীভাবে।’ তাঁর স্বামী এনাম আলী (৩৮) এই সময়ে হাওরে মাছ ধরেন। কিন্তু হাওরে এখন মাছ মিলে কম। তাই টাঙ্গুয়ার হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে প্রতিদিন নৌকায় কিছু লাইফ জ্যাকেট নিয়ে যান। একেকটি লাইফ জ্যাকেট ২০-৩০ টাকায় ভাড়া দেন পর্যটকদের কাছে। সারা দিনে যা পান, তাই দিয়ে এখন সংসার চলে। এ কাজে ১২ বছর বয়সী ছেলেকেও লাগিয়েছেন। এনাম বলছিলেন, ‘ইবার ভিটা রক্ষায় কাজ করাতে ১২ হাজার টাকা গেছে। ঋণ আছি ৭ হাজার টাকা। খাই না খাই, বাড়ির ভিটা ত আগে রক্ষা করত অইব।’
টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার পাশাপাশি থাকা জয়পুর, গোলাবাড়ি, রূপপুর, ছিলান তাহিরপুরসহ আরও কয়েকটি গ্রাম ঘুরে একই দৃশ্য দেখা গেল। সবাই আফাল থেকে বসতভিটা রক্ষায় বাঁশ, আড়ের বেড়া দিয়েছেন। কেউ কেউ পাথর দিয়ে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। তবে জয়পুর গ্রামের দক্ষিণ পাশে আফাল থেকে গ্রাম রক্ষায় পাকা প্রতিরক্ষা দেয়াল চোখে পড়ল। এটি বেশ কয়েক বছর আগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) একটি প্রকল্পে করা হয়েছিল। জেলার আরও কিছু হাওরে গ্রাম রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এভাবে কিছু কিছু পাকা গ্রাম প্রতিরক্ষা দেয়াল করা হয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় হাওরে প্রচুর হিজল-করচের গাছ ছিল। এসব গাছ ঢেউয়ের সামনে বুক পেতে বাড়িঘর আগলে রাখত। এখন গাছগাছালি কমে যাওয়ায় সরাসরি ঢেউ আঘাত হানে বসতভিটায়। সবকিছু তছনছ করে দেয়। টাঙ্গুয়ার হাওরে সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে কাজ করা জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা আহমদ কবীরের (৪০) সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, হাওরে সম্পদ কমছে। এটির প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনমানে। মানুষ এখন তিন বেলার খাবার নিয়েই দুশ্চিন্তায়। এ অবস্থায় বসতভিটা রক্ষার এই কাজ বাড়তি চাপ।
শুধু টাঙ্গুয়ার হাওর নয়, সুনামগঞ্জের সব হাওর এবং হাওরপাড়ের মানুষের জীবনচিত্র প্রায় একই রকম। মানুষের জীবন হাওরের ওপর নির্ভরশীল। বর্ষায় তাঁদের তেমন কাজ থাকে না। মাছ ধরা, কৃষিকাজ ছাড়া কোনো বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগও নেই। অন্যদিকে হাওরে মাছ কমছে। অকালবন্যায় ঝুঁকি বাড়ছে বোরো ফসলের। হাওরে সম্পদ কমায় জীবনযাপন এখানে দিন দিন কঠিন হচ্ছে, এমনটাই মানুষের মত।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বলেন, ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাহিরপুরে এসেছিলেন। তিনি হাওরের মানুষের প্রতি খুবই আন্তরিক। তখন অনেক দাবির সঙ্গে হাওরের বোরো ফসল ও গ্রাম সুরক্ষার দাবিও করেছিলেন তাঁরা। তাঁর নির্দেশনাতেই পরে হাওরের বিভিন্ন গ্রামে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এটি যত বাড়বে, হাওরপাড়ের মানুষ তত বেশি উপকৃত হবে।