ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পর ঝালকাঠিতে রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠের দিকে ঝুঁকছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু জ্বালানি কাঠের দামও বাড়তি। বিক্রেতারা মণপ্রতি ৫০-৭০ টাকা বেশি নিচ্ছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। সংসার খরচের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।
শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন রমজানে এলপিজি গ্যাসের সংকটসহ আরও দাম বাড়ার আশঙ্কায় অনেকেই বাড়িতে জ্বালানি কাঠ কিনে মজুত করছেন। অনেকে আবার ফ্ল্যাট বাড়িতে গ্যাসের চুলার পাশাপাশি জ্বালানি কাঠের জন্য মাটির চুলা বসিয়ে নিচ্ছেন। জ্বালানি কাঠ বিক্রেতারাও গ্রামাঞ্চল থেকে গাছপালা কিনে জ্বালানি হিসেবে বিক্রির জন্য মজুত করছেন। এমন চলতে থাকলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদেরা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ঘোষণা অনুযায়ী, ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা। তবে ঝালকাঠি পৌর এলাকা ও আশপাশের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বিক্রেতারা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি রাখছেন। এতে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে। বিক্রেতারা বলছেন, পরিবেশকদের (ডিলার) কাছ থেকেই বেশি দামে গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে। এ জন্য খুচরা বাজারেও দাম বেশি।
আজ শনিবার সকালে শহরের পালবাড়ির একটি জ্বালানি কাঠের দোকানে কাঠ কিনতে এসেছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এনায়েত ফকির। তিনি বলেন, ‘গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাসার রান্নাঘরে মাটির চুলা বসিয়ে নিয়েছি। রমজানকে সামনে রেখে ৫০ মণ জ্বালানি কাঠ মজুত করে নিচ্ছি। কিন্তু সুযোগ বুঝে কাঠ ব্যবসায়ীরাও মণপ্রতি বাড়িয়ে দিয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জ্বালানি কাঠের দোকানে প্রতি মণ চেরাই করা চাম্বল ও রেইনট্রি কাঠ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকায়, যা এক মাস আগেও বিক্রি হতো ২৮০ টাকায়। পুরোনো ঘরের ভাঙা কাঠ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, যা আগে বিক্রি হতো ২৫০ টাকায়। করাতকলে ছাঁটাই করা কাঠ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা মণ, যা আগে বিক্রি হতো ১৫০ টাকায়।
জ্বালানি কাঠ বিক্রেতা এন্তাজ ব্যাপারী বলেন, গ্রামাঞ্চল থেকে বেশি দামে গাছ কিনে চেরাই করতে হয়। পরিবহন খরচ ছাড়াও কাঠুরেকেও মণপ্রতি ২৫-৩০ টাকা দিতে হয়। তাই জ্বালানি কাঠের দাম বেড়ে গেছে।
ঝালকাঠি পৌর এলাকার পশ্চিম ঝালকাঠি এলাকার বাসিন্দা আয়নাল হক ছোট একটি মুদিদোকান পরিচালনা করেন। সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়ায় জীবন নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে তাঁর জন্য। আয়নাল হক বলেন, সব জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। আবার কয়েক দফা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সর্বশেষ এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাসের ১৫ তারিখের পরেই সংসার খরচের জন্য ধারদেনা করতে হয়।
গ্যাসের চেয়ে কাঠ দিয়ে রান্নায় সাশ্রয় হয় বলে জানালেন আড়তদারপট্টি এলাকার স্কুলশিক্ষক ভারতী রানী। তিনি বলেন, একটি সংসারে রান্নার জন্য পাঁচ মণ জ্বালানি কাঠ লাগে। মণপ্রতি ৩৫০ টাকা হারে এতে খরচ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫০ টাকা। অপর দিকে এক মাসের রান্নার জন্য দুটি গ্যাসের সিলিন্ডারের প্রয়োজন হয়, যার বাজারমূল্য ৩ হাজার ২০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে জ্বালানি কাঠ ব্যবহারে একটি পরিবারের ১ হাজার ৪৫০ টাকা সাশ্রয় হয়।
ঝালকাঠি সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, সরকার গাছের ওপর চাপ কমাতে এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডার তৃণমূল পর্যায়ে সহজলভ্য করেছে। কিন্তু সাশ্রয় করতে গিয়ে জ্বালানি কাঠের জন্য গাছ কাটলে তা পরিবেশের ওপর বিপর্যয় ডেকে আনবে।
জেলা ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, ভালো দামের আশায় গ্রামাঞ্চলের মানুষ গাছ কেটে উজাড় করছেন। এতে পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়বে। তাই একটি গাছ কাটলে তিনটি গাছ লাগানো উচিত।
জেলা শহরের আড়তদারপট্টি এলাকায় একটি খুচরা দোকানে সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে আসেন পালবাড়ি এলাকার জব্বার মিয়া (৪৫)। তিনি ১২ লিটারের সিলিন্ডার গ্যাস কেনেন ১ হাজার ৬২০ টাকায়। তিনি বলেন, ‘আমাগো দুর্দশা দ্যাহার কেউ নাই! বাজারে হগোল (সব) জিনিসের দাম বাড়ছে। এহন সিলিন্ডার গ্যাসের দামও বাড়ায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।’
শহরের আড়তদারপট্টি এলাকার বিক্রেতা জামাল হোসেন বলেন, সর্বশেষ দাম বাড়ার পর থেকে তিনি পরিবেশকদের কাছ থেকে ১২ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডার ১ হাজার ৫৫০ টাকায় কিনছেন। এরপর সিলিন্ডারপ্রতি ৫০ টাকা লাভে ১ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি করছেন। আর সিলিন্ডার বাড়িতে পৌঁছে দিলে ১ হাজার ৬৫০ টাকা নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহরের কুমারপট্টি এলাকায় এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাসের পরিবেশক লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত ১২ লিটার সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৪৯৮ টাকা। আমরা সেই দামেই বিক্রি করছি। তবে খুচরা বিক্রেতারা ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দরে কিছু লাভে বিক্রি করছেন।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ইন্দ্রানী দাস বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে এলপিজি গ্যাস বিক্রি নিশ্চিত করতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে ভোক্তারা যেন সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে পারেন, সেটিই বাস্তবায়ন করা হবে।