বালু নিয়ে খেলা করায় শিশুকে ডোবায় নিক্ষেপ, সেই শাহজাহান এখনো অধরা

শিশু নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

কুমিল্লার বুড়িচংয়ে বালু নিয়ে খেলা করায় চার বছর বয়সী এক শিশুকে ডোবার নোংরা পানিতে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় মামলা হলেও এখনো গ্রেপ্তার হননি সেই শিক্ষক মো. শাহজাহান। পুলিশের ভাষ্য, থানায় মামলা হওয়ার আগেই গা-ঢাকা দিয়েছেন শাহজাহান। তাঁকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ।

গত বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে বুড়িচং সদর ইউনিয়নের বুড়িচং পূর্বপাড়া এলাকার মঞ্জুর আলী সর্দারের বাড়ির সামনে ডোবায় ওই শিশুকে ফেলে দেন শাহজাহান। শিশু মিফতাহুল মাওয়া বুড়িচং পূর্বপাড়া মঞ্জুর আলী সর্দার বাড়ির সৌদিপ্রবাসী নজির আহমেদের মেয়ে।

এ ঘটনায় হওয়া মামলার একমাত্র আসামি মো. শাহজাহান একই এলাকার বাসিন্দা। তিনি বুড়িচং সদরের ফজলুর রহমান মেমোরিয়্যাল কলেজ অব টেকনোলজির শিক্ষক। এরই মধ্যে এ ঘটনায় ৪ মিনিট ১২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা।
মিফতাহুল মাওয়া নামের শিশুটি বর্তমানে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছে। হাসপাতালে শিশুটির সঙ্গে আছেন তাঁর মা শামছুন নাহার ও মামা আলাউদ্দিন বায়েজিদ।

আজ শনিবার সকালে আলাউদ্দিন বায়েজিদ প্রথম আলোকে বলেন, মিফতাহুল মাওয়া এখনো ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ আঁতকে ওঠে। শাহজাহান তাকে উল্টো করে ডোবার নোংরা পানিতে নিক্ষেপ করেছিল। যার কারণে আমার ভাগনির মাথা পানির মধ্যে ডুবে ছিল। অল্পের জন্য সে প্রাণে বেঁচে গেছে। নোংরা পানিতে ফেলার কারণে তার মাথা, মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট গোটাসহ চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। ঘটনার পর থেকেই মেয়েটার নিউমোনিয়া–জ্বর শুরু হয়। এখন জ্বর অনেকটাই কমেছে। চিকিৎসক বলেছে আরও দুয়েক দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে।

আলাউদ্দিন বায়েজিদ বলেন, ‘আমার ভাগনি কোনো অন্যায় করলে অভিভাবকদের কাছে বিচার দিতে পারতেন শাহজাহান। কিন্তু তিনি সেটি না করে চার বছরের একটা শিশুকে মেরেই ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি। এমন জঘন্য একজন মানুষের শিক্ষক হওয়ার কোনো অধিকার নেই। আমরা তার সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। যদিও থানায় মামলা হওয়ার দুই দিন হলেও এখনো তিনি গ্রেপ্তার হননি। আমরা দ্রুত তাঁর গ্রেপ্তার চাই। এরই মধ্যে তাঁর পক্ষ নিয়ে এলাকার প্রভাবশালী মহল আমাদেরকে কল করে বিষয়টি আপস করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা আপস নয়, তাঁর বিচার চাই।’

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশুটির সঙ্গে থাকা তাঁর মা শামছুন নাহার ওরফে তানিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি ঘটনার পর যখন তিনি (শাহজাহান) বললেন, তাঁর কাছে শিশুর জীবনের চেয়ে বালুর মূল্য বেশি। তখনই বুঝতে পেরেছি, তাঁর মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব নেই। ৫০ বছর বয়সী একজন শিক্ষক কীভাবে এমন কাজ করতে পারেন! তাঁকে শিক্ষক বললে, শিক্ষকসমাজকেই কলঙ্কিত করা হবে। আমি তাঁকে বলবো দুর্বৃত্ত। অবিলম্বে তাঁর গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। আমার মেয়ের হত্যার চেষ্টাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আমার মেয়েটা এখনো আতঙ্কে আছে। বারবার চিৎকার করে উঠছে। মেয়েটার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’

শামছুন নাহার বলেন, ‘শাহজাহান আমাদের প্রতিবেশী। তাঁরা বাড়ির নির্মাণ করছেন। আমার সন্তানরা কোনো অন্যায় করলে তিনি আমাদের কাছে বিচার দিতে পারতেন। কয় টাকার বালু কষ্ট করেছে বাচ্চারা, আমরা সেই ক্ষতিপূরণ দিতাম। কিন্তু তিনি নোংরা ডোবার পানির মধ্যে আমার বাচ্চাটাকে যেভাবে ফেলে দিয়েছেন, এটা কোনো মানুষের কাজ হতে পারে না। তিনি অমানুষের মতো আচরণ করেছেন। আমার বড় মেয়েটা ছোট বোনকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে তাঁর পায়ে ধরেছে। তিনি আমার বড় মেয়েকে লাথি মেরে বাসায় ঢুকে গেছেন। আমি তাঁর দৃষ্টান্তমুলক শান্তি চাই।’

থানায় মামলা হওয়ার আগ থেকেই শাহজাহান পলাতক রয়েছেন বলে জানান বুড়িচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আজিজুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা তাঁকে (শাহজাহান) ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে তাঁকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’

ঘটনার পর থেকে শিক্ষক শাহজাহানের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে শাহজাহানের ছেলে নূর-এ শাহান রাজ বলেন, ‘আমার বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে যা করেছেন, তাঁর জন্য আমরা সবাই দুঃখিত। আসলে আমার বাবা অসুস্থ, এ জন্য এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। আর প্রায়ই আমাদের বাড়ির নির্মাণসামগ্রী বাচ্চাটা নষ্ট করছিল, তাই তিনি উত্তেজিত হয়েছিলেন। তবে এখন তাঁরা (শিশুর পরিবারের সদস্যরা) ঘটনাটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন। বিভিন্ন বানোয়াট কথা বলে আমার বাবাকে হয়রানির চেষ্টা করছেন।’

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে শিশু মিফতাহুল মাওয়া ও তার বড় বোন ১০ বছর বয়সী গালিবা সুলতানার সঙ্গে বাসা থেকে খেলতে বের হয়। একপর্যায়ে তারা সড়কের পাশে রাখা বালুতে হাত দিয়ে খেলা করছিল মাওয়া। বালু প্রতিবেশী শাহজাহানের। তিনি শিশুদের বালুতে খেলা করতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে চার বছরের ওই শিশুকে দুই হাত দিয়ে তুলে পাশের একটি পরিত্যক্ত ডোবার নোংরা পানিতে ফেলে দেন। এ সময় শিশুটির বড় বোন গালিবা সুলতানা শাহজাহানের পা ধরে ক্ষমা চাইলেও তিনি শিশুটিকে পানি থেকে না তুলে বাসায় চলে যান। পরে গালিবার চিৎকারে শিশু মাওয়াকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন এক পথচারী নারী। তিনি দ্রুত শিশুটিকে নোংরা পানি থেকে উদ্ধার করেন। পরে পরিবারের লোকজন শিশুটিকে দ্রুত বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছে শিশুটি।

এ ঘটনার ৪ মিনিট ১২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, শিশুটির মা শামছুন নাহার, শাহজাহানকে বলছিলেন, ‘আপনার মধ্যে কি মনুষ্যত্ব নেই? একটু বালু ফেলে দিয়েছে বলে আপনি এভাবে আমার বাচ্চাকে পানিতে ফেলে দিবেন? আপনার বালুর মূল্য আছে, আমার বাচ্চার মূল্য নাই?’ উত্তরে শাহজাহান বলেন, ‘না, আমার কাছে বালুর মূল্য বেশি। তোমার বাচ্চা এখানে এসে বালু ধরেছিল কেন। তোমার বাচ্চা আমার এখানে আসবে কেন?’