গাজীপুর মহানগরীর বাঙ্গালগাছ বাঁশপট্টি এলাকায় পিটিয়ে ও কুপিয়ে দুই ভাইকে হত্যার পর থেকে পরিবারের সদস্যদের আহাজারি থামছে না। মা ও স্ত্রীদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের মর্গ এলাকা। ঘটনাস্থলে বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা।
আজ শনিবার দুপুরে মর্গের সামনে গিয়ে দেখা যায়, মা জুলেখা খাতুন বসে বিলাপ করছেন। স্বামীদের হত্যার বিচার দাবিতে ডুকরে কাঁদছেন নিহত শফিকুল ইসলামের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার ও শুকুর আলীর স্ত্রী মিনা খাতুন। আহাজারি করতে করতে জুলেখা খাতুন বলেন, ‘বিকেল পাঁচটার সময় আমার ছেলে বলে গেল বাঙ্গালগাছ যাচ্ছি কাঠের দোকানদার থেকে টাকা আনতে। কী নিয়ে যেন আগে তাদের মধ্যে মারামারি হয়েছিল। তারপর মামলা করে। ওই মামলায় আমার দুই ছেলে দুবার করে জেল খেটেছে। জেল দিয়েও ওদের মন ভরেনি। আমার বুকের ধনকে ওরা পিটিয়ে মেরে ফেলল।’
গতকাল শুক্রবার রাতে এক অটোরিকশাচালকের মাধ্যমে দুই ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাঙ্গালগাছ এলাকায় ছুটে যান পরিবারের সদস্যরা। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পান, দুজনের রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে রয়েছে তিন রাস্তার মোড়ে। পরক্ষণেই ৯৯৯–এ ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। এরপর মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের মর্গে।
শফিকুলের বড় ভাই আমিরুল ইসলাম বলেন, শফিকুল ও শুকুর আলীর কাছ থেকে বাঙ্গালগাছ এলাকার হিমেল, সুমন ও রাসেল কিছুদিন আগে ১০ হাজার টাকা ধার নেন। গতকাল টাকা দেওয়ার কথা ছিল। সেই টাকা আনার জন্য অটোরিকশা নিয়ে শফিকুল ও শুকুর বাঙ্গালগাছ এলাকায় যান। সেখানে তাঁদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হলে দুই ভাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
স্থানীয় একটি সূত্র পুলিশের কাছে দাবি করেছে, বৃহস্পতিবার রাত সাতটার দিকে একদল লোক ধারালো অস্ত্রসহ বাঙ্গালগাছ এলাকায় আসে। টাকাপয়সা লেনদেনকে কেন্দ্র করে তারা একটি দোকানে হামলা চালায়। একপর্যায়ে লোকজন তাদের ধাওয়া দিয়ে ধরে মারধর, গণপিটুনি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলে ঘটনাস্থলে দুজনের মৃত্যু হয়।
শফিকুল ও শুকুর আলী ময়মনসিংহের নান্দাইল থানার মহিষকুরা গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। আবুল কাশেম রিকশাচালক। নগরের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভূরুলিয়া এলাকায় পাশাপাশি মহল্লায় আলাদা বাসায় ভাড়া থাকেন পরিবারের সদস্যরা। মা–বাবা থাকেন তরুবীথি এলাকায়। একই এলাকায় আলাদা বাসায় থাকতেন শুকুর আলী। শফিকুল থাকতেন সরকারপাড়ায়।
আজ সকালে বাঙ্গালগাছ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে রয়েছে। চারপাশে থমথমে অবস্থা। সেখানে ১০-১৫টি দোকান থাকলেও খোলা রয়েছে মাত্র দুটি। তবে তারাও ঘটনার বিষয়টি জানেন না বলে স্পষ্ট বলে দিলেন। বাঙ্গালগাছ মোড়ে প্রতিদিন রিকশা থাকলেও আজ কোনো রিকশা বা মানুষের আনাগোনা দেখা যায়নি।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গাজীপুরের পুলিশ সুপার মাকছুদের রহমান বলেন, ঘটনাস্থলের পাশে একটি দোকানে সিসিটিভি লাগানো ছিল। কিন্তু সেখান থেকে কোনো ফুটেজ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। যে দোকানে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল, ওই দোকানদার বলছেন, ঘটনার পর হামলাকারীরা সিসিটিভির যন্ত্রাংশ লুট করে নিয়ে গেছে।
পরে সেখান থেকে নিহত ব্যক্তিদের ভাড়া বাসা ভূরুলিয়ায় গেলে কোনো বাসায় পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। পাশের বাসার ও স্থানীয় লোকজন বলছেন, শফিকুলের চলাফেরা তেমন ভালো ছিল না। কয়েকবার বিবাদেও জড়ান। তবে শুকুর আলী রিকশা চালাতেন। ছেলে হিসেবে ভালো ছিলেন। একটি মারামারির ঘটনায় জেল খেটে কয়েক দিন আগেই বের হয়েছেন দুই ভাই। তবে ঘটনা যা–ই হোক, এভাবে মেরে ফেলাটা মানতে পারছেন না তাঁরা।
পরবর্তী সময়ে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে পাওয়া যায় পরিবারের সদস্যদের। নিহত শফিকুলের ভগ্নিপতি মো. আক্তারুল বলেন, তাঁরা লাশের ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছেন। লাশ দুটি দাফন করা হবে গাজীপুরের ভবানীপুর এলাকায়।
নিহত ব্যক্তিদের মা জুলেখা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি এখন কী নিয়ে বেঁচে থাকব? আমার দুই সন্তানকেই তো ওরা মেরে ফেলেছে। দুই ছেলের ঘরে চার সন্তান আছে। ছোট ছেলের ঘরে হাসিখুশি দুই যমজ সন্তান আছে। এদের কে দেখবে, ছেলের বউদের কী হবে? আমি ছেলেদের হত্যার বিচার চাই। আমি জীবিত থাকতেই ওদের বিচার চাই।’
গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিয়াউল ইসলাম বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন। লাশ দুটি মর্গে রয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় চারটি মামলা পেয়েছেন। সেগুলোও তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কারা, তাঁদেরও খোঁজা হচ্ছে।