পাহাড়ের নাম জাহাজপুরা, দেখার আছে অনেক কিছু

কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের পূর্ব পাশের জাহাজপুরা পাহাড়। গত শুক্রবার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

সাগরের অদূরেই উঁচু পাহাড়। পাশে ২০০ বছর বয়সী গর্জনের বাগান নজর কাড়ে যে কারও। রয়েছে পানের বরজ, সুপারিগাছের সারি; আর সাগরের বালুচরে লাল কাঁকড়ার দৌড়াদৌড়ি, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য তো আছেই। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার জাহাজপুরায় দেখা মিলবে এমন দৃশ্য।

কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে দক্ষিণ দিকে ৭০ কিলোমিটার গেলে সামনে পড়ে বিচ্ছিন্ন একটি পাহাড়খণ্ড। পাহাড়ে গাছপালা নেই। দূর থেকে পাহাড়টি দেখতে পায়ের গোড়ালির মতো লাগে। এই পাহাড়ের নামই জাহাজপুরা। পাহাড়ের নিচে জাহাজপুরা গ্রাম।

যে কারণে নাম জাহাজপুরা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টেকনাফ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশ সেনাদের হাতে। আর নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে অবস্থান নেন জাপানি সৈন্যরা। দুই পক্ষের মধ্যে তখন কামানের গোলা ছোড়াছুড়ি হতো।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, ওই সময় আকাশে চক্কর দেওয়া অবস্থায় একটি যুদ্ধবিমানে আগুন ধরে গিয়েছিল। যুদ্ধবিমানটি টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শিলখালী এলাকার উঁচু এই পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল। তখন পাহাড়ের চূড়ায় যুদ্ধবিমানটিতে অনেকক্ষণ ধরে আগুনে জ্বলতে থাকে। উড়োজাহাজ পুড়ে যাওয়ার এ ঘটনা থেকেই স্থানীয়ভাবে পাহাড়টির নাম হয়ে যায় জাহাজপুরা।

উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জাহাজপুরা পাহাড়টির উচ্চতা ছিল ৮৮০ ফুট। এর মূল নাম তুনঙ্গানঙ্গা। এটি জেলার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। তিন দশক আগেও এই পাহাড় বড় বড় গর্জন, সেগুন ও চাপালিশগাছে ভরপুর ছিল। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সেসব গাছ কেটে পাহাড় সাফ করে ফেলেছেন। ঝড়বৃষ্টিতে ক্ষয় হয়ে পাহাড়টির উচ্চতাও কমে আসছে।

কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের জাহাজপুরা পাহাড়ের বিপরীতে সমুদ্রসৈকতে মাছ ধরার রঙিন নৌকার সারি
ছবি: প্রথম আলো

যা যা দেখার আছে

তুনাঙ্গানাঙ্গা পাহাড়ের নিচে জাহাজপুরা গ্রামটি সুপারিগাছে ভরপুর। বাগানে ঢুকে গাছ থেকে সুপারি কাটা ও বেচাবিক্রির দৃশ্য, পাশের পানের বরজ, বরজে পান কাটার দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ইচ্ছা হলে পানের সঙ্গে সুপারি মিশিয়ে এক খিলি পানও খেয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

স্থানীয় শিলখালী বন রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, মেরিন ড্রাইভে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকালে অন্যান্য পাহাড় থেকে বিচ্ছিন্ন ‘জাহাজপুরা’ পাহাড়টি দেখা যায়। যাঁদের কাছাকাছি আসার সময় বা সুযোগ নেই, তাঁরা মেরিন ড্রাইভে দাঁড়িয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করেন। আর যাঁরা পাহাড় দেখতে আসেন, তাঁরা দেশের গর্জনের বনটি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করেন না। এই বনের একেকটি গর্জনগাছের বয়স ২০০ থেকে ২১০ বছর। গর্জন বনের ভেতরে হরিণ, হাতিসহ নানা বন্য প্রাণীর বিচরণও রয়েছে। গাছে গাছে শত শত বানরের লাফালাফি, পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ যেকোনো বয়সী মানুষকে মুগ্ধ করে।

বন রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আরও বলেন, বাগানটির গর্জনগাছের ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারা সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে প্রাকৃতিক এই বনে গর্জনগাছ আছে ৬ হাজার ৩৮০টি। প্রতিদিন কয়েক শ নারী-পুরুষ গর্জন বন দেখতে আসেন। গবেষণার জন্য ছুটে আসেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। পিকনিকের জন্যও অনন্যস্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই গর্জনের বন।

জাহাজপুরা গ্রামের আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ। নিরিবিলি পরিবেশে গ্রামটিতে রাত কাটাতে পারেন পর্যটকেরা। জাহাজপুরা গ্রামের পাশে জাহাজপুরা সমুদ্রসৈকতে গেলে দেখা মেলে গাঙচিলের ওড়াউড়ি, রঙিন নৌকায় জেলেদের মাছ ধরার প্রস্তুতিসহ নানা দৃশ্য। সাগরের বালুচরে অপেক্ষা করলে দেখা মিলবে মাছ ধরে নিয়ে আসার মুহূর্তও। সেই মাছ আবার বিক্রিও হয় বালুচরে। মাছ মাচাংয়ে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করার প্রক্রিয়াও দেখা যাবে বালুচরে।

কক্সবাজার (দক্ষিণ) বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজপুরা পাহাড় ও গর্জনের বনে আসা পর্যটকদের বন বিভাগের কর্মীরা নিরাপত্তা দিচ্ছেন। সম্প্রতি পাহাড়ে অপহরণকারী চক্র আস্তানা করায় অনুমতি ছাড়া পর্যটকদের জাহাজপুরা পাহাড়ের গহিনে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়।

জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, মুক্তিপণের জন্য বেশ কয়েকজনকে পাহাড়ে তুলে নিয়ে আটকে রাখার ঘটনা ঘটেছে। মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরাও পাহাড়ে আস্তানা গেড়েছে। পুলিশ ও র‌্যাব পৃথক অভিযান চালিয়ে চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও জাহাজপুরায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি।