শিবচরে বিএনপি নেতার ছায়ায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ‘পুনর্বাসন’
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কামাল জামান নুরুদ্দীন মোল্লার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ‘বিতর্কিত’ নেতাদের পুনর্বাসন করার অভিযোগ উঠেছে। তিনি আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতা-কর্মীকে বিএনপিতে যোগদানের ব্যবস্থা করেছেন বলে অভিযোগ। এ ঘটনায় বিএনপির স্থানীয় নেতারা ছাড়াও তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
এলাকায় নুরুদ্দীন মোল্লা নামে পরিচিত কামাল জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ অক্টোবর তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি। পরে তিনি শোকজের জবাব দিলে জবাব ‘অসন্তোষজনক’ উল্লেখ করে ১০ অক্টোবর তাঁকে সতর্ক করে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে প্রায় ছয় বছর পর এলাকায় ফেরেন নুরুদ্দীন মোল্লা। গত ১৪ আগস্ট শিবচরে বিশাল শোডাউন দিয়ে তিনি সমাবেশ করেন। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকায় একটি সুধী সমাবেশ ও মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন তিনি। ওই সভায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ছাড়াও ছাত্রলীগ, যুবলীগের শতাধিক নেতা-কর্মীকে বিএনপিতে যোগদান ও পুনর্বাসন করানোর অভিযোগ ওঠে।
সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মারা যাওয়া শিবচরের সন্ন্যাসীরচর এলাকার হৃদয় হোসেন হত্যা মামলার ৭৪ নম্বর আসামি ও কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সজীব ব্যাপারী ৩০ সেপ্টেম্বর নুরুদ্দীন মোল্লার সুধী সমাবেশে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। ওই সমাবেশের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন হৃদয় হত্যা মামলার ১৮ নম্বর ও শিবচরের ভান্ডারীকান্দি ইউনিয়নের নাইমুর রহমান হত্যা মামলার ৩৭ নম্বর আসামি কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোহসিন উদ্দীন সোহেল ব্যাপারী। এ ছাড়া যোগদান করা উল্লেখযোগ্য নেতারা হলেন সন্ন্যাসীরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা কহিনুর হাওলাদার, কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সালাউদ্দিন মোল্লা, চরজানাজাত ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা মোতাহার মাস্টার প্রমুখ। আওয়ামী লীগের নেতাদের বিএনপিতে যোগদানের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
শিবচরে বিএনপির পাঁচটি পক্ষ। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন নুরুদ্দীন মোল্লা। অন্য চারটির নেতৃত্বের আছেন উপজেলা বিএনপির একাংশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইয়াজ্জেম হোসেন, বিএনপি নেতা নাদিরা মিঠু চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী ও উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জহের গোমস্তা। নুরুদ্দীন মোল্লার বিরুদ্ধে এই চার নেতা সম্প্রতি একত্র হয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
একাংশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নুরুদ্দীন মোল্লার কর্মকাণ্ডে আমরা খুবই বিব্রত। ১৫ বছর ধরে শিবচরে বিএনপি অগোছালো ছিল। সবাই মিলে আমরা শিবচরে বিএনপিকে গোছাতে কাজ করছি। আর নুরুদ্দীন মোল্লা আওয়ামী লীগের লোকজন বিএনপিতে ভিড়িয়ে পুনর্বাসন সেন্টার খুলে বসেছেন। তাঁর লোকজন থানা ও ইউএনও অফিস দখল করে চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে। তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে আমরা কেন্দ্রে অভিযোগ জানিয়েছি। তবু অদৃশ্য কারণে কোনো সুরাহা হচ্ছে না।’
জানতে চাইলে নুরুদ্দীন মোল্লা নিজেকে শিবচর উপজেলা বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক দাবি করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার দায়িত্ব আমার হবে কেন? যদি কখনো করি তাহলে বিএনপির লোকজনকে পুনর্বাসন করব। যারা আমার বিরুদ্ধে এমন বিভ্রান্তকর কথা বলছে, তারাই আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছে। তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বিএনপি থেকে দূরে সরানোর কাজ করছে। কিন্তু জনগণ তো আমাকে চায়। আমি শিবচরে গেলে হাজার হাজার মানুষ চলে আসে। যারা আমার বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের সাথে ১০ জনও থাকে না। আসল কথা, শিবচরে দল–মতনির্বিশেষে মানুষ আমাকে পছন্দ করে। আমি মানুষের জন্য কাজ করি।’
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বিগত দিনে তাঁরা বিএনপির জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এখন তৃণমূলের লোকজন নিয়ে কাজ করতে চান। নুরুদ্দীন মোল্লা বিএনপির কেউ নন। তাঁর কারণে তৃণমূলের অনেকেই বিব্রত। বিএনপির খারাপ সময়ে নুরুদ্দীন মোল্লা ছিলেন না। তিনি সুযোগসন্ধানী। যদি তিনি মন থেকে বিএনপির করতেন, তাহলে ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাঁকে পাওয়া যেত।
ছাত্রলীগ থেকে বিএনপিতে নুরুদ্দীন মোল্লা
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নুরুদ্দীন মোল্লার চার ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই লতিফ মোল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের আওয়ামী লীগ মনোনীত সর্বশেষ চেয়ারম্যান। ১৯৯০ সালে নুরুদ্দীন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে রাজনীতি ছেড়ে তিনি জাপান চলে যান। প্রবাস থেকে ফিরে ২০০৯ সালে তিনি মাদারীপুর-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচন করে হেরে যান। এরপর বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ২০১০ সালে শিবচর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হননি।
জানতে চাইলে নুরুদ্দীন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বিএনপি করেন এবং আজীবন বিএনপি করে যাবেন। স্বার্থান্বেষী মহল তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ছড়াচ্ছে। তবে ছাত্রলীগের রাজনীতি ও পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।