ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তিন চাকার যানের দৌরাত্ম্য 

২০২২ সালের জুলাইয়ে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল সব ধরনের তিন চাকার যানবাহন চলাচল। এসব যান আবার ফিরে এসেছে।

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবাধে চলছে তিন চাকার যানবাহন। গত বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বোর্ডবাজার এলাকায়প্রথম আলো

বছরখানেক বন্ধ থাকার পর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে আবারও শুরু হয়েছে তিন চাকার যানবাহন চলাচল। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবাধে চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, মিশুক, ভ্যানের মতো ছোট যানবাহন। এতে সড়কটিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। যানজটের পাশাপাশি মাঝেমধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবহনচালক সূত্রে জানা যায়, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সড়কটিতে আগে থেকেই চলত তিন চাকার যানবাহন। এর মধ্যে ২০২২ সালের জুলাইয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশের তখনকার কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম উদ্যোগ নিয়ে সড়কটির আবদুল্লাহপুর থেকে সালনা চৌরাস্তা পর্যন্ত সব ধরনের তিন চাকার যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এতে সড়কে স্বস্তি ফেরে। দুর্ঘটনা ও ভোগান্তি—দুটোই কমে যায়। কিন্তু এক বছর না পেরোতেই গত সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর থেকে সড়কটিতে ধীরে ধীরে শুরু হয় তিন চাকার যান চলাচল। এখন পুরোদমে চলছে এসব যান। ফলে সড়কটিতে আবার দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা।

বেশির ভাগ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই দায়ী থাকে অবৈধ তিন চাকার যানের চালকেরা। কিন্তু দিন শেষে শাস্তি পেতে হয় বড় গাড়ির চালককে। 
সুলতান সরকার, সভাপতি, গাজীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন 

গাজীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সুলতান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অবৈধ তিন যাকার যানবহনের কারণে আমাদের পরিবহন সেক্টরটা ধ্বংস হয়ে গেল। বেশির ভাগ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই দায়ী থাকে অবৈধ তিন চাকার যানের চালকেরা। কিন্তু দিন শেষে শাস্তি পেতে হয় বড় গাড়ির চালককে। অনেক সময় হত্যা মামলারও শিকার হন আমাদের চালকেরা। আমরা বারবারই এসব বন্ধের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বলি, কিন্তু কাজ হয় না।’

গত বৃহস্পতিবার সকালে সড়কটির আবদুল্লাহপুর থেকে সালনা বাজার পর্যন্ত প্রায় ১৭ কিলোমিটার সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সড়কটি দিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাসহ গাজীপুরের আশপাশের এলাকার বিভিন্ন গাড়ি রাজধানী ঢাকায় চলাচল করছে। বিপরীত দিক থেকে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে আসা গাড়ি চলাচল করছে। এর মধ্যেই সড়কটিতে পাল্লা দিয়ে চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, নছিমন, ভ্যানগাড়িসহ প্যাডেলচালিত রিকশা। এসব যানবাহন একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কখনো মাঝসড়ক দিয়ে, আবার কখনো উল্টো পথে চলাচল করছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক যান চলাচল।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গাজীপুর মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে সব সময়ই আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এখন কিছু গাড়ি চলছে, তবে এটা খুব বেশি না। অচিরেই এসব যান চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

গত ২১ ডিসেম্বর দুপুরে বোর্ডবাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির সামনে থেকে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে নগরের তারগাছ এলাকায় যাচ্ছিলেন মোমেনা ও কুলসুম আক্তার নামের দুই নারী। রিকশাটি ময়মনসিংহমুখী সড়কে চলছিল উল্টো পথে। কিছু দূর যেতেই ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা একটি বাসের সঙ্গে ধাক্কা লাগে রিকশাটির। সঙ্গে সঙ্গে সড়কে ছিটকে পড়েন চালকসহ মোমেনা ও কুলসুম। এর মধ্যে গুরুতর আহত হন মোমেনা। স্থানী বাসিন্দারা তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল এবং পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মোমেনার ছোট ভাই মো. কাউছার প্রথম আলোকে বলেন, ওই দুর্ঘটনার পর মোমেনার বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে যায়। পঙ্গু হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে এখন তিনি বাড়িতে। তবে এখনো সুস্থ না হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারছেন না। চিকিৎসকের ভাষ্যমতে মোমেনার পুরো সুস্থ হতে সময় লাগবে অন্তত আরও এক মাস।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুরা ২৭ থেকে একটি প্যাডেলচালিত রিকশায় চড়ে হোসেন মার্কেটের দিকে যাচ্ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. জিয়াউল ইসলাম। মহাসড়কে রিকশায় চড়া ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও কেন এসেছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মহাসড়কের কাছাকাছি স্টেশনগুলোতে যাওয়ার জন্য কোনো পরিবহন নেই বা অল্প দূরত্ব শোনে বাসে উঠান না চালকেরা। সড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার আলাদা কোনো লেনও নেই। তাই বাধ্য হয়েই মহাসড়কে রিকশায় চলাচল করি। তা ছাড়া রিকশাও সহজেই পাওয়া যায়।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ গাজীপুর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, হাইকোর্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ২২ মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন (ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, নছিমন, করিমন, ভটভটি ইত্যাদি) নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। কিন্তু সাত বছর পরও সেই নির্দেশ পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। এরপর ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকার সঙ্গে যুক্ত পাঁচ মহাসড়কে ওই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত দেয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ওই পাঁচ সড়কের একটি ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। কিন্তু তারপরও শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে।

এ বিষয়ে গাজীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক আবু নাঈম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়কের তিন চাকার যান নিয়ন্ত্রণ বা ট্রাফিক শৃঙ্খলার বিষয়টা পুলিশ দেখে। পুলিশ যখন আমাদের ডাকে বা কোনো অভিযান পরিচালনা করে, তখন আমরা যাই, তাদের সব রকম সহযোগিতা করি।’