দুই সপ্তাহে ১৪ জন অপহরণ, চন্দনাইশের পাহাড়েই কি সন্ত্রাসীদের আস্তানা
চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার সীমান্তবর্তী কচুয়াইয়ের পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতে সক্রিয় হয়ে উঠছে একটি সন্ত্রাসী চক্র। এ অবস্থায় অপহরণের আতঙ্কে দিন কাটছে বাসিন্দাদের। সন্ত্রাসীদের ভয়ে পাহাড়ে থাকা ফলের বাগান ও কৃষিজমিতেও যেতে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা।
জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২০ মে ও ৬ জুন পৃথক দুটি ঘটনায় ১৪ জনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে সন্ত্রাসী চক্রটি। এর মধ্যে গত ২০ মে অপহরণ করা হয় ৯ জন এবং ৬ জুন অপহরণ করা হয় ৫ জনকে। ২০ মে অপহৃতরা মোট আড়াই লাখ টাকা এবং ৬ জুন অপহৃতরা এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান।
৬ জুন অপহরণ হওয়া পাঁচ ব্যক্তি হলেন চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের কাঞ্চননগর এলাকার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন (৫০), আবদুল মালেক (৬০), জোবাইদুল ইসলাম (২২), আবছার উদ্দিন (৩৫) ও কচুয়াই চা-বাগান স্বপ্ননগরের দিনমজুর সুভাষ দাশ (৪০)। জনপ্রতি ২০ হাজার করে মোট ১ লাখ টাকা পরিশোধ করে পরদিন দুপুরে তাঁরা ছাড়া পেয়েছেন।
সম্প্রতি স্বপ্ননগর এলাকায় গিয়ে কথা হয় ৬ জুন অপহরণ হওয়ার পর মুক্তিপণ আদায় করে ছাড়া পাওয়া সুভাষ দাশের সঙ্গে। সুভাষ বলেন, তিনি সকাল ১০টার দিকে লাকড়ি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। বাড়ির অদূরে পাহাড়ের জিনজিরারমুখ নামক স্থানে পৌঁছানোমাত্র ওত পেতে থাকা ছয় ব্যক্তি তাঁকে ধরে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলেন। এরপর একটি পেয়ারাগাছের সঙ্গে বেঁধে তাঁকে লাঠি দিয়ে পেটাতে পেটাতে বলেন, ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে। একই সময়ে স্থানীয় বাসিন্দা নাজিম, আবুল মালেক, আবছার ও জোবাইদুলকেও সেখানে অপহরণ করে নিয়ে এসে মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
কথা বলার সময় নিজের শরীরের বিভিন্ন স্থানে থাকা আঘাতের চিহ্নও দেখান সুভাষ দাশ। মুক্তিপণের বিষয়ে তিনি বলেন, অপহৃতদের মধ্য থেকে মুক্তিপণ আনার জন্য নাজিমকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নাজিম প্রত্যেকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অপহৃত প্রত্যেকের জন্য ২০ হাজার টাকা করে মুক্তিপণ নিয়ে আসেন। এরপর অপহৃতদের ছেড়ে দেওয়া হয়। অপহরণকারীরা সবাই পাহাড়ি বলে জানান সুভাষ দাশ।
একই দিন অপহরণ হওয়া জোবাইদুল ইসলামের বাবা জসিম উদ্দিন বলেন, এলাকার চাইল্যা মারা পাহাড়ে তিনিসহ অনেক মানুষের বাগান রয়েছে। ওই দিন সকালে তিনি ও তাঁর ছেলে বাগান থেকে লেবু সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। লেবু নিয়ে আসার সময় তিনি কিছুটা পেছনে এবং ছেলে জোবাইদুল সামনে ছিল। হঠাৎ ধর ধর বলে চিৎকার শুরু হলে তিনি পালিয়ে পাহাড়ের একটি গর্তে লুকিয়ে থাকেন। পালানোর সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হলেও গায়ে লাগেনি। তবে তিনি পালাতে পারলেও তাঁর ছেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যান সন্ত্রাসীরা। ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ পরিশোধ করে ছেলেকে ছাড়াতে হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কচুয়াইয়ের পাহাড়ি এলাকায় লেবু, পেঁপে, লিচু, পেয়ারা, কাঁঠাল, সুপারি, আম, আনারসের অনেক বাগান রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে শাকসবজির খেত। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই পুরোপুরি পাহাড়ের এসব বাগান এবং চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়ে অপহরণকারীদের তৎপরতা বাড়ায় চাষিরা তাঁদের বাগান ও খেতে যেতে পারছেন না।
চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুস শুক্কুর পাহাড়ে অপহরণকারী চক্রের তৎপরতা বাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, মাত্র ১৮ দিনের ব্যবধানে ১৪ জনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে। জিরিরমুখ নামের পাহাড়ি এলাকাটি পটিয়া থানা এলাকার। কিন্তু সেখানে বেশির ভাগ বাগান ও জমি কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দাদের। বিষয়টি চন্দনাইশ থানাকে বললে কর্মকর্তারা বলেন, ঘটনাস্থল পটিয়া। পটিয়া থানায় বললে তারা বলে, ঘটনা তো চন্দনাইশের।
চন্দনাইশ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) যুযুৎ যশ চাকমা বলেন, ‘অপহরণের বিষয়টি নিয়ে পটিয়া ও চন্দনাইশ থানাকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমরা তৎপর রয়েছি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অপহরণকারী চক্রটির সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ জড়িত রয়েছেন।’