সংসারের অভাব ঘোচাতে পড়ালেখার পাশাপাশি কালাই রুটি বিক্রি করেন তাঁরা

ফুটপাতে কালাই রুটি তৈরি করে বিক্রি করেন তাঁরা। শুক্রবার রাতে রাজশাহী নগরের সোনাদিঘির মোড়েছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীতে শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায় দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সঙ্গে ছিল ঠান্ডা বাতাস। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আর কোনো ক্রেতা নেই দেখে হাতের আটা ধুয়ে নিলেন তাঁরা। যাবেন শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট এলাকায়। কিন্তু যে রিকশায় এসেছেন, সেই রিকশাওয়ালা যাবেন, রাত একটা-দেড়টার দিকে। তাই খোলা আকাশের নিচে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তাঁরা।

কাঁকনহাট থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাঁচজন শিক্ষার্থী রাজশাহী নগরে আসেন। গভীর রাত পর্যন্ত তাঁরা ফুটপাতে কালাই রুটি তৈরি করে বিক্রি করেন। আবার গ্রামে তাঁরা ফিরে যান। পড়ালেখার পাশাপাশি এভাবেই প্রতিদিন চলে তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই।

শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজশাহী নগরের সোনাদিঘির মোড়ের ফুটপাতের দোকানে শিক্ষার্থী সানাউল্লাহর সঙ্গে প্রথম কথা হয়। তিনি জানালেন, গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়েন তিনি। তাঁর বাবা কৃষিকাজ করেন। বাড়ি কাঁকনহাট পৌর এলাকার রাজারামপুর চাত্রা এলাকায়। দুই বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি (সানাউল্লাহ) দ্বিতীয়। প্রতিদিন তাঁরা শহরে কালাই রুটি বিক্রি করতে আসেন। সংসারের অভাব মেটাতে পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁকে এই কাজ করতে হয়। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই তিনি এই কাজ করছেন। এখন প্রতিদিন মহাজন তাঁকে ৫০০ টাকা মজুরি দেন। এ থেকে ৫০ টাকা খাওয়া বাদ যায়। রিকশায় যাতায়াতের জন্য ১০০ টাকা লাগে। বাকি সাড়ে ৩০০ টাকা তাঁর প্রতিদিনের রোজগার।

সানাউল্লাহ জানালেন, এই শহরে তাঁর মালিকের তিনটি দোকান আছে। বাকি দুটি দোকানের একটি হচ্ছে জাদুঘর মোড়ে, অপরটি সরকারি মহিলা কলেজ মোড়ে। প্রতিটি দোকানে দুজন করে শিক্ষার্থী রুটি তৈরি করেন। শুধু তাঁর (সানাউল্লাহর) সহযোগী নয়ন পড়াশোনা করে না।

জাদুঘর মোড়ের দোকান চালান আলমগীর ও তাঁর ছোট ভাই আমানুল্লাহ। আলমগীর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। আর তাঁর ছোট ভাই উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্র।
মহিলা কলেজ মোড়ে দোকান চালান মোফাজ্জল ইসলাম। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মোফাজ্জলই সবার বড়। তিনি সম্প্রতি গোদাগাড়ী কলেজ থেকে বিএ পাস করেছেন। বাবা কৃষিকাজ করেন। তাঁর সঙ্গে আছেন মো. সুমন। তিনি গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাঁরা দুই ভাই, দুই বোন। তাঁদের মধ্যে সুমন দ্বিতীয়। বাবা কৃষিকাজ করেন।

সোনাদিঘির মোড়ে সানাউল্লাহর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেল, তাঁদের গ্রামে ৬৮টি পরিবারের বসবাস। গ্রামের পাঁচ-ছয়টি পরিবার বাদে প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা রুটি তৈরি করেন। রাজশাহী শহর ছাড়াও বিভিন্ন পশুর হাটে রুটি বিক্রি করেন তাঁরা। ফুটপাতে তাঁর (সানাউল্লাহর) দোকান। পেছনে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় দুটি করে বেঞ্চ পাতা। তাতে বসে রুটি খাচ্ছিলেন রাজশাহী কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী আঁখি খাতুন ও জুবায়ের হাসান। তাঁরা দুজনেই প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ করেছেন।
আঁখি খাতুন বললেন, ‘এখানকার রুটি ভালো লাগে। কিছুটা বাড়ির স্বাদ পাওয়া যায়। আমি নিজে খেয়েছি। রুমমেটের জন্য পার্সেলও নিয়েছি।’

শহরের বঙ্গবন্ধু কলেজের শিক্ষার্থী মো. শামীম হোসেন পাশের বেঞ্চে বসে খাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে পলাশ নামের একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে এসেছেন। দুজনেই রুটির দোকানে খেতে বসেছেন। শামীম বললেন, বাজারে কেক কিনতে এসেছিলেন। হাতের কাছে রুটির দোকান দেখেই খেতে বসেছেন। এই রুটি মুখরোচক, খেতে ভালো লাগে।

কয়েক দিন আগে রাজশাহীর ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক নাহফুজা রনি এই শিক্ষার্থীদের দোকানে কালাই রুটি খেয়ে প্রশংসা করেছেন। সানাউল্লাহ বললেন, প্রতিদিন তাঁদের অন্তত ১০০টি রুটি বিক্রি হয়। প্রতিটি রুটির দাম ৩০ টাকা। আর বেগুন ভর্তার দাম ১০ টাকা, তবে কাঁচা মরিচের ঝাল ফ্রি দেওয়া হয়।

রাতেই রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ মোড়ে গিয়ে পাওয়া গেল মোফাজ্জল ইসলাম ও সুমনকে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত সাড়ে ১১টা বেজে গেল। মোফাজ্জল বললেন, ‘লেখাপড়া শিখে শুধু চাকরির আশায় বসে থাকলে জীবন মাটি হয়ে যাবে। তাই হাতের কাছে যা পেয়েছি, তা–ই করছি। ভবিষ্যতে চাকরি–বাকরি হলে করব, না হলে বসে থাকব না।’

মোফাজ্জলের দৈনিক মজুরি ৮০০ টাকা, আর সুমনের ৬০০ টাকা। তবে বিক্রি বেশি হলে মালিক আরও ৫০ টাকা ধরে দেন। এখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কম, তাই বিক্রি কম। তা ছাড়া প্রতিদিন ২০০টি রুটি বিক্রি হয়। তাঁরা কালাই রুটি বিক্রি শেষে মালিককে নগদ টাকা বুঝিয়ে দেন।

মোফাজ্জল বললেন, যাঁদের রিকশায় সন্ধ্যাবেলা এসেছেন, তাঁরা শহরে ভাড়া মারবেন। রাত একটা-দেড়টার দিকে যখন বাড়ি যাবেন, তখন তাঁদের রিকশায় ফিরবেন। চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া ১০০ টাকা। কিন্তু আলাদাভাবে গেলে অনেক টাকা খরচ। তাই খরচ বাঁচাতে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় রিকশার জন্য। শহর থেকে বের হয়ে পবা উপজেলার দামকুড়া বাজার পার হওয়ার পর ফাঁকা মাঠ আর মাঠ। তখন হু হু করে বাতাসে বুকের মধ্যে কাঁপন শুরু হয়, সেটা সহ্য করাই কঠিন।