শোলাকিয়ায় দেশের বৃহৎ ঈদের জামাতে লাখো মুসল্লির নামাজ আদায়
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়ায় এবারও দেশের বৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মাঠের রেওয়াজ অনুযায়ী, বন্দুকের ফাঁকা গুলির শব্দের মাধ্যমে আজ শনিবার সকাল ১০টায় জামাত শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা কয়েক লাখ মুসল্লির এ জামাতে ইমামতি করেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ।
নামাজ শেষে দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনার পাশাপাশি মহান আল্লাহর কাছে মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়। লাখো মুসল্লির ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে ময়দান।
শোলাকিয়ায় এবার অনুষ্ঠিত হলো পবিত্র ঈদুল ফিতরের ১৯৬তম জামাত। এতে অংশ নিতে আজ সকাল থেকে দূরদূরান্তের মুসল্লিরা দলে দলে আসতে শুরু করেন। সকাল সোয়া ৯টার দিকে মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে নামাজ শেষে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে মোনাজাত করে বাড়ি ফেরেন মুসল্লিরা।
এই ঈদের জামাত নির্বিঘ্নে করতে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। মোতায়েন করা হয়েছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ), পাঁচ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং জেলা পুলিশের সহস্রাধিক সদস্য। মাঠের ভেতর ও বাইরে ছিল ৬৪টি সিসিটিভি ক্যামেরা, পুরো মাঠ পর্যবেক্ষণের জন্য ছিল চারটি ড্রোন। ছয়টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে আগত ব্যক্তিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়।
এ ছাড়া মাঠের ভেতর-বাইরে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তায় ছিল বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক দল। নিরাপত্তার স্বার্থে কাউকে মুঠোফোন, ছাতা বা কোনো ধরনের ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শুধু পাতলা জায়নামাজ নিয়ে নামাজ আদায় করতে আসেন মুসল্লিরা। নিষেধ ছিল দেশলাই বা লাইটার সঙ্গে না রাখার। মুসল্লিদের যাতায়াতে দুটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ কমিটির সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় লাখো মুসল্লির সমাগম ঘটে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে।
২০১৬ সালের ঈদুল ফিতরের দিনে অপ্রত্যাশিত হামলার বিষয়টি মাথায় রেখে এবারও মাঠে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। নির্বিঘ্নে নামাজ আদায় করে মুসল্লিরা ঘরে ফেরায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ।
শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা পর্ষদ সূত্র জানায়, ৬ দশমিক ৬১ একর আয়তনের ঈদগাহের মূল মাঠে ঈদের জামাতে প্রায় আড়াই শ কাতার ছিল। প্রতিটি কাতারে ৫০০ থেকে ৬০০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। এ ছাড়া মাঠের আশপাশের রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় কয়েক লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করেন।
বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়ায় প্রথম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈশা খাঁর বংশধর দেওয়ান হয়বত খাঁ কিশোরগঞ্জের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর এ ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে মাঠের জমির পরিমাণ আরও বাড়ানো হয়। দেওয়ান মান্নান দাদ ছিলেন হয়বত খাঁর বংশধর। হয়বত খাঁ ছিলেন ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর। যে কারণে শুরু থেকে এ মাঠের জমিদারির একটা ঐতিহ্য রয়েছে। এটা তৎকালীন জমিদারের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ ছিল বলে ইতিহাসবিদদের কাছে জানা যায়।
তৎকালীন সময়ে জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খান ঘোড়ার গাড়িতে সিংহাসন বসিয়ে বিশাল বাহিনী নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে এ মাঠে নামাজ পড়তে আসতেন। এ ছাড়া ইটনা হাওরের জমিদারসহ বিভিন্ন এলাকার জমিদারেরা পক্ষীরাজের মতো নৌকা সাজিয়ে এ ঈদগাহে নামাজ পড়তে আসতেন। জমিদারদের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন বলে দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর লোকজন জড়ো হতেন মাঠে। এভাবেই এ মাঠের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
কিশোরগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে শোলাকিয়া মাঠ নিয়ে দুটি জনশ্রুতির বর্ণনা রয়েছে। এর একটি হলো, মুঘল আমলে এখানকার পরগনার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল শ লাখ টাকা। মানে এক কোটি টাকা। কালের বিবর্তনে শ লাখ থেকে বর্তমান শোলাকিয়া হয়েছে। আরেকটি বর্ণনায় আছে, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। সেই থেকে এটি শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।