পাবনার সুজানগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের বিরোধ বাড়ছেই। নির্বাচনের পর হত্যা, মারধর, একে অন্যের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, লুটতরাজসহ নানা সহিংসতা চলছে। এতে উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। হামলা-লুটপাটে দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হচ্ছেন।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৮ মে সুজানগরে ভোট হয়। নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল ওহাব ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহিনুজ্জামান চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, পদ্মার বালুমহাল দখলসহ নানা বিষয় নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। এর মধ্যে দুই নেতা প্রার্থী হলে কর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু থেকেই দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধমকি দিচ্ছিল।
নির্বাচনের আগে ২৩ এপ্রিল ও ২ মে সন্ধ্যায় দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। এতে গুলিবিদ্ধসহ অন্তত সাতজন আহত হন। এরপর ৬ মে রাতে প্রায় ২৩ লাখ টাকাসহ র্যাবের হাতে আটক হন সাধারণ সম্পাদক শাহিনুজ্জামান। পরে মুচলেকা দিয়ে তিনি ছাড়া পান। ৮ মে ভোটে শাহিনুজ্জামানকে হারিয়ে আবদুল ওহাব চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে বিরোধ আরও প্রকট হয়। শাহিনুজ্জামান সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান।
এলাকাবাসী ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের পর দুই প্রার্থীর সমর্থকেরা একে অন্যের বাড়িঘরে হামলা ও মারধর শুরু করেন। ভোটের পরদিন ৯ মে জয়ী আবদুল ওহাবের সমর্থকেরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিজয় মিছিল বের করেন। তাঁরা উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের ক্ষেতুপাড়া; সাগরকান্দি ইউনিয়নের গোবিন্দপুর, শ্রীপুর, দুর্গাপুর; সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাটপাড়া ও আহম্মদপুর ইউনিয়নের সোনাতলা, বাদাইসহ বিভিন্ন গ্রামে পরাজিত শাহিনুজ্জামানের সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর করেন। একই দিনে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরাও কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালান। এরপর ২৫ মে উপজেলার দক্ষিণ রানীনগর গ্রামে সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। এরপর ৮ জুন উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের কাদুয়া গ্রামে অটোরিকশাস্ট্যান্ড দখল নিয়ে আবার সংঘর্ষ হয়। এতে ২০ জন আহত হন। স্ট্যান্ডটি আগে সাবেক চেয়ারম্যান শাহিনুজ্জামানের সমর্থকদের দখলে ছিল। নির্বাচিত হওয়ার পর ওহাবের সমর্থকেরা দখলে নিতে গেলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সর্বশেষ গত শনিবার উপজেলার রানীনগর গ্রামে আল-আমিন মিয়া (৩৫) নামে শাহিনুজ্জামানের এক সমর্থককে কুপিয়ে জখম করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। নিহত আল-আমিন ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য। হত্যাকাণ্ডের পরদিন শাহিনুজ্জামানের সমর্থকেরা রানীনগর গ্রামে আবদুল ওহাবের সমর্থকদের অন্তত ১৫টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালান। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের চাচাতো ভাই আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেছেন। তবে ভাঙচুরের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার শেষ প্রান্তে রানীনগর গ্রাম। গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা কৃষিজীবী। টিনের ঘরে ভাঙচুরের চিহ্ন। অনেকের ঘরের বেড়ায় কোপের দাগ। কয়েকটি বাড়ির আসবাব তছনছ করা হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, হামলাকারীরা সামনে যা পেয়েছে তা–ই ভাঙচুর করেছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘরের টিনের বেড়া কেটেছে। গ্রামের ফয়সাল হোসেনের হাঁসের খামার, রফিকুল বিশ্বাস, শামীম হোসেন, রাসেল হোসেনের বাড়ি থেকে গরু এবং মাহাতাব শিকদারের বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ফয়সাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো রাজনীতি করেন না। সাদামাটা জীবন যাপন করেন। দুই হাজার হাঁস নিয়ে তাঁর একটি খামার ছিল। হামলাকারীরা সেই হাঁস লুট করে নিয়ে গেছে। কী কারণে লুটপাট, তিনি বুঝতে পারছেন না।
রানীনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক তৌফিক হাসান বলেন, নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর মধ্যে। কিন্তু তাঁরা রোষানল থেকে মুক্তি পাননি। তাঁদের কার্যালয়, বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। বিনা কারণে তাঁকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চান।
বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান জি এম তৌফিকুল আলম বলেন, ‘আমার জানামতে দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় দুই পক্ষের বিরোধ চলছে। বিরোধের জেরে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে। অন্যদিকে খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। তবে কারা কেন করেছে, আমার জানা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিদিন গ্রামে টহল দিচ্ছে। তাঁরা তদন্ত করলেই বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।’
জানতে চাইলে পরাজিত প্রার্থী শাহিনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের পর জয়ী প্রার্থীর সমর্থকেরা তাঁর নেতা-কর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছেন। যাকে যেখানে পাচ্ছে, সেখানেই মারধর করছে। রানীনগরে তাঁর এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা বিষয়গুলো থানা-পুলিশকে জানিয়েছেন। কয়েকটি মামলাও করা হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।
অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জয়ী প্রার্থী আবদুল ওহাব। তিনি বলেন, রানীনগরে পারিবারিক বিরোধে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে। সেটিকে নির্বাচনী রং লাগাচ্ছে প্রতিপক্ষ। নির্বাচনী বিরোধ বলে মানুষের ঘরবাড়িতে হামলা, লুটপাট করছে। তাঁরা বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছেন। আশা করছেন, পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
রানীনগর ইউনিয়নটি জেলার আমিনপুর থানার আওতাধীন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর রানীনগরে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে ভাঙচুরের ঘটনায় কেউ মামলা করেননি। তাঁরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন।