আশ্রয়কেন্দ্রে স্বেচ্ছায় পাঠদান

আশ্রয়কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন মৌলভীবাজারের বড়লেখার দাসের বাজার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস
প্রথম আলো

বাড়িঘরে পানি ওঠায় নিরুপায় হয়ে পরিবারগুলো ঠাঁই নিয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে খাদ্যের কিছু বন্দোবস্ত হলেও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছেদ পড়েছে। সেখানে মা–বাবার সঙ্গে তাঁদের স্কুল ও কলেজপড়ুয়া সন্তানেরাও আছে। এমনিতে করোনা অতিমারির কারণে দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করতে পারেনি তারা। এবার বন্যার কারণে সমস্যা প্রকট হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশ্রয়কেন্দ্রে এসে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন।

বন্যার পানিতে অনেকের বই, খাতা-কলম ভেসে গেছে। অনেক পরিবারকে মূল্যবান সামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য, ধান–চাল ফেলে আসতে হয়েছে বাড়িতে। এ পরিস্থিতিতে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এলেও বন্যার্ত মানুষের জীবন যেন থমকে আছে। যেখানে দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করাটাই কষ্টের, সেখানে পড়াশোনা করার চিন্তা করা অকল্পনীয়। তবে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও মৌলভীবাজারের বড়লেখার দাসের বাজার উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে মা–বাবার সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করার সুযোগ পাচ্ছে। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস ও তাঁর সহযোগী সহকারী শিক্ষক মো. হাসেম আলী এই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যাকবলিত বড়লেখার হাকালুকি হাওরপারের দাসের বাজার ইউনিয়নের দাসের বাজার উচ্চবিদ্যালয়ে খোলা হয় একটি আশ্রয়কেন্দ্র। গত ২২ জুন থেকে এলাকার পশ্চিম শংকরপুর, বুলুয়া, পানি সওয়া, পূর্ব শংকরপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে ৫৩টি পরিবার এই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। শুরু থেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া সবার দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস। তাঁকে সহযোগিতা করছেন ওই বিদ্যালয়েরই সহকারী শিক্ষক মো. হাসেম আলী। শুরুতে তাঁরা নিজেরা আশ্রয় নেওয়া মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। পরে তাঁদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন স্থানীয় আরও অনেকেই। কখনো স্থানীয় মানুষ খাবার দিচ্ছেন, কখনো উপজেলা প্রশাসন থেকেও খাবার দেওয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রে প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২৪ জন শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৫ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৪ জন, পঞ্চম শ্রেণিতে ৪ জন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১ জন, সপ্তম

শ্রেণিতে ১, অষ্টম শ্রেণিতে ৫ জন এবং দশম শ্রেণির একজন। বেলা ১১টা থেকে দেড়টা-দুইটা পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে।

প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস পড়ান ইংরেজি এবং সহকারী শিক্ষক হাসেম আলী পড়ান গণিত ও বিজ্ঞান। শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই এই পাঠদানকে তাঁরা আটকে রাখছেন না। গানসহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করছেন।

শুরু থেকেই এই আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন পূর্ব লঘাটি গ্রামের রোজিনা বেগম নামের এক গৃহিণী। ওই দুই শিক্ষকের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। খুব কষ্টত আছি, অসহায়। স্কুলের স্যাররা খুব উপকার কররা (করছেন) আমরার। এরমা ঝে আশ্রয়কেন্দ্রে যত ছাত্র আইছে (এসেছে), সবাইরে পড়ারা। খাতা-কলমও দেরা (দিচ্ছেন)। খুব আন্তরিক তারা। ইখানোতো (এখানে) পড়ালেখার কোনো সুযোগই নাই। তারার (তাদের) কারণে পড়তা পাররা (পড়তে পারছে)। আমরার বাইচ্চাইনতর (ছেলেমেয়েদের) খুব উপকার অর (হচ্ছে)।’

সাংস্কৃতিক সংগঠক রিপন দাস গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার কানে ইংরেজি গ্রামার পড়ার শব্দ আসে। বিদ্যালয় ভবনের দোতলায় গিয়ে দেখি সেখানে ক্লাস চলছে। শিক্ষার্থীদের খাতা-কলম দিচ্ছেন স্যাররা। তখনই জানলাম আশ্রয়কেন্দ্রে আসা শিক্ষার্থীদের তাঁরা স্বেচ্ছায় পড়াচ্ছেন। বিষয়টি খুব ভালো লেগেছে।’

বন্যার্ত মানুষদের খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি তাঁদের সন্তানদের পাঠদান করার এই মহৎ উদ্যোগের বিষয়টি কীভাবে মাথায় এসেছে, জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস বলেন, ‘আমরা সব সময় কেন্দ্রে থাকি। দেখলাম কেন্দ্রে কিছু

শিক্ষার্থী আছে এলাকার, কিছু আমাদের স্কুলের। সবাইকে খাতা-কলম কিনে দিয়ে পড়ানো শুরু করেছি। সব শিক্ষার্থী পড়ায় খুব মনোযোগী। অভিভাবক, শিক্ষার্থী সবাই খুশি। কেউ ক্লাস মিস করে না। ঈদের তিন দিন বন্ধ ছিল, তা–ও তারা বন্ধের সময় এসেছে। এখানে সার্বক্ষণিক থাকায় আমরা তাদের পরিবারের মানুষ হয়ে গেছি। এই কাজ করে ভালোই লাগছে।’