ক্যানসারজয়ী শিক্ষকের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজন–সহকর্মীরা

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত স্কুলশিক্ষিকা তোজাম্মিন শাহনাজের পরিবারকে সান্তনা দিতে বাড়িতে এসেছেন দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। আজ দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার মিত্রবাটী এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে সবে সংসার আর শিক্ষকতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিলেন। ক্যানসারজয়ী সেই তোজাম্মিন শাহনাজ গতকাল শনিবার প্রাণ হারিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। তাঁর এমন মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছেন না স্বজন, সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা।

তোজাম্মিন শাহনাজের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার মিত্রবাটী এলাকায়। তিনি উপজেলার দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে আজ রোববার স্কুলের পাঠদান বন্ধ রেখে বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা। তাঁরা তোজাম্মিনের স্বামী তোয়াবুর রহমানকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সেখানে কথায় কথায় জানা গেল তোজাম্মিনের ক্যানসার জয়ের গল্প।

তোজাম্মিনের সঙ্গে ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নুর নাহার। তিনি বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে যতটা সময় কেটেছে, তা বাড়ির লোকজনের সঙ্গেও কাটেনি। তোজাম্মিনের মৃত্যু আমাকে যে কষ্ট দিয়েছে, পরিবারে কেউ মারা গেলে সেই কষ্ট পাব কি না, জানি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্যানসার নাকি মরণব্যাধি? সেই ক্যানসারকে তিনি জয় করে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছিলেন। সেই মানুষটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবে কখনো ভাবিনি!’ কথা বলতে বলতে কণ্ঠ ধরে আসে নুর নাহারের। একসময় ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে লাগলেন, ‘তোজাম্মিন যদি ক্যানসারে মারা যেতেন, তবে হয়তো এত কষ্ট লাগত না। আজ খুব কষ্ট লাগছে।’

দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সিনতি রানী রায় বলেন, ‘শীতের সময় রোদ পোহাতে খুব পছন্দ করতেন আপা। স্কুলে পাঠ শেষে সুযোগ পেলে তিনি চেয়ার নিয়ে রোদে বসে পড়তেন। বৃহস্পতিবার রোদের দেখা পেতে দুপুর লেগে যায়। সে সময় তিনি আমাকে ডেকে বলেন, ‘‘আজ রোদটা কেবল আমর জন্যই উঠল।’’ এখন প্রতিদিনই রোদ উঠছে। কিন্তু আপা আর সেই রোদ পোহাতে বসবেন না!’

আরও পড়ুন

তোজাম্মিনের স্বামী তোয়াবুর রহমান পীরগঞ্জের কাস্তোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে তোজাম্মিনের। সেই থেকে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয় তাঁর। চিকিৎসার পেছনে ২৮ থেকে ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। নিয়মিত চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসে কেবল সংসার আর শিক্ষকতা সামলাতে শুরু করেছেন তিনি।
তোজাম্মিন–তোয়াবুর দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে তকি তাহমিদ এবারে এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ–৫ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে ভবিষ্যতে তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করবে। সেই স্মৃতিচারণা করে তোয়াবুর বলেন, ‘এখন মা হারা ছেলে কতটুকু প্রস্তুতি নিতে পারবে, কে জানে?’

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে বাসের ধাক্কায় ভ্যান দুমড়েমুচড়ে যায়। শনিবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

ফেরার সময় তোয়াবুর রহমান বলেন, ‘শুক্রবার রাতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমার চাচা শ্বশুর (তোজাম্মিনের চাচা) মারা গেছেন। শেষবারের মতো তাঁর মরদেহ দেখার জন্য সকালে মা (তোজাম্মিনের মা) ও মেয়েকে নিয়ে রওনা হয় তোজাম্মিন। পথে একটি যাত্রীবাহী বাসচাপায় সে–ও মারা গেল। সড়ক দুর্ঘটনায় দুই স্বজনের মৃত্যু এখন আমাকে বইতে হচ্ছে।’

স্থানীয় লোকজন জানান, শনিবার সকালে মেয়ে ও মাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাটারিচালিত একটি ভ্যানে চড়ে চাচার মরদেহ দেখার জন্য ভেলাতৈড় ভদ্রপাড়ার দিকে রওনা হন তোজাম্মিন শাহনাজ। পথে পীরগঞ্জ থানার ৫০ গজ দক্ষিণে একটি যাত্রীবাহী বাস তাঁদের ভ্যানটিকে চাপা দেয়। ভ্যানটি দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে তোজাম্মিন শাহনাজ মারা যান। এ ঘটনায় ভ্যানে থাকা তাঁর মেয়ে তানিসা আক্তার, তাঁর মা সাজেদা খাতুন ও ভ্যানচালক ভূমি লাল আহত হন।

আহত ভ্যানচালক ভূমি লালকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোববার দুপুরে ভূমি লালের বাড়িতে দেখা যায় স্বজনদের ভিড়। ভূমি লালের স্ত্রী নিরোবালা, মেয়ে দুলি রানী ও ছেলে মানিক তাঁর সঙ্গে হাসপাতালে আছেন। ভূমি লালের মা দুলু বালা (৭৫) বলেন, ‘ছুয়াটা মানুষের ভ্যান দিয়া ভাত খায়। ওই ভ্যানটাত বাসখান ধাক্কা দিল। জীবনখান বাঁচিলেও হাতের হাড্ডি ভাঙ্গি গেইছে। অ্যালা নাকি অপারেশন করিবা লাগিবে। অপারেশনে অনেক টাকা খরচ হবে। হামরা গবির মানুষ এত টাকা কুনঠে পামো।’

পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, বাসচাপায় স্কুলশিক্ষিকা নিহত হওয়ার ঘটনায় সড়ক পরিবহন আইনে পীরগঞ্জ থানার একটি মামলা হয়েছে। চালককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফসানা মিমি। পঞ্চম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী পিউ রানী বলে, ‘আপা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি আর স্কুলে আসবেন না ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।’