রাজশাহী-নওগাঁ সড়কের গাছ যেন সাইনবোর্ডের খুঁটি
রাজশাহী-নওগাঁ সড়কের দুই পাশে লাগানো হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি গাছ। অল্প বয়সী গাছগুলো সবে বেড়ে উঠছে। সেই গাছের গায়ে পেরেক গেঁথে টাঙানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সাইনবোর্ড। সারি সারি গাছের দিকে তাকালে মনে হবে সাইনবোর্ডের খুঁটি। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গাছে পেরেক মারলে সেখানে মরিচার সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে গাছে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিয়ে গাছের নানা অসুখবিসুখ তৈরি করে। গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়, ঝড়–বৃষ্টিতে সহজেই গাছ ভেঙে যায়।
সাবেক এক বন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শাজাহান সিরাজ যখন বন ও পরিবেশমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি একদিন রমনা পার্কে গিয়ে গাছের গায়ে পেরেক গেঁথে সাইনবোর্ড লাগানো দেখে এক নির্বাহী আদেশ জারি করেছিলেন, কেউ গাছে পেরেক মারলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২০০২ সালের ১৭ জুলাই গাছে পেরেক গেঁথে সাইনবোর্ড না লাগানোর ব্যাপারে সংসদে আইন পাস হয়েছিল। সেই আইন কোথাও কার্যকর হচ্ছে না।
রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান শাহ বলেন, গাছে পেরেক মারা নিষিদ্ধ, এটা তিনি জানেন। কিন্তু কোন আইনে নিষিদ্ধ বা এ মর্মে কী নির্দেশনা জারি হয়েছিল, সেটা তাঁর কার্যালয় খুঁজে পাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত কেউ তাঁদের কাছে অভিযোগও করেননি। সত্যিই যদি গাছে পেরেক মেরে সাইনবোর্ড লাগানো হয়, তাহলে তাঁরা তা অপসারণের ব্যবস্থা করবেন।
রাজশাহী-নওগাঁ সড়কের নওহাটা সড়কের দুই পাশে ৫০ হাজারের বেশি জারুল, কাঞ্চন, আকাশমণি, আম ও কাঁঠালগাছ লাগিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বৃক্ষপালন বিভাগ। গাছগুলো সদ্য বেড়ে উঠছে। গাছগুলোয় এখন পেরেক গেঁথে বিভিন্ন সাইনবোর্ড লাগানোর হিড়িক পড়েছে। বিশেষ করে বাজার বা জনবসতি এলাকায় সাইনবোর্ডের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড, রাজনৈতিক নেতার সাইনবোর্ড, পোশাক বিক্রির দোকানের ঠিকানা বদলের সাইনবোর্ড।
মোটরসাইকেলে রাজশাহী-নওগাঁ সড়ক ধরে চলতে চলতে মোটামুটি একটা হিসাব করে দেখা গেছে, রাজশাহীর নওহাটা থেকে মোহনপুরের কেশরহাট পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার সড়কে ১২৮টি সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। মোহনপুর উপজেলা সদর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে সাঁকোয়া পর্যন্ত ৪৭টি এবং মোহনপুর সদর থেকে উত্তরে কেশরহাট পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার সড়কে ৭৭টি সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। পুরো সড়কেই এভাবে কোথাও কম, আবার কোথাও ঘন করে সাইনবোর্ড লাগানো দেখা যায়। পেরেক গেঁথে সাইনবোর্ড লাগানোর ব্যাপারে স্থানীয় লোকজনের কোনো মাথাব্যথা নেই। কেউ এর প্রতিবাদও করেন না।
গাছে পেরেক মারলে ক্ষতি হয় কি না জানতে চাইলে সওজের নির্বাহী বৃক্ষপালনবিদ বিপ্লব কুমার কুন্ডু বলেন, মানুষ গাছে আঘাত করলে অসুবিধা হয়। গাছেরও তেমনটিই হওয়ার কথা। তিনি বলেন, সাইনবোর্ডগুলো রাতের অন্ধকারে লাগানো হয়েছে। তা ছাড়া দীর্ঘ সড়কে কোথায় কে সাইনবোর্ড লাগাচ্ছে, তদারকি করা কঠিন। সাইনবোর্ডগুলো খোলার ব্যবস্থা করা যায় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁদের দায়িত্ব সড়কে গাছ লাগিয়ে দুই বছর পর্যন্ত পরিচর্যা করে সিভিল প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা। গাছের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব সওজের সিভিল বিভাগের। তাঁরা ৫০ থেকে ৭৫ হাজার গাছ রোপণ করেছেন। গাছগুলোর বয়স দুই বছর পার হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে সওজের রাজশাহীর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হাকিম বলেন, বিবেক থেকেই গাছে সাইনবোর্ড না লাগানো উচিত। রাতের অন্ধকারে কারা সাইনবোর্ড লাগায়, কয়জনের বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন। তাঁদের তো এত লোকবল নেই। তারপরও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে কি না, জেনে দেখবেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল বলেন, মানুষের মতো গাছের প্রাণ আছে। আঘাত করলে কষ্ট পায়। এটা মানুষেরই সবচেয়ে ভালো বোঝা উচিত। তাঁরা বিভিন্ন সেমিনারে, বিশেষ করে যেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তারা থাকেন, তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সাধারণ মানুষের উদ্দেশে সচেতনতামূলক কথাবার্তা বলেন।