ব্যস্ততা আর টুংটাং শব্দে ঘেরা একটি চা–দোকানের গল্প

অলক দেবকে চা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। মৌলভীবাজার শহরের সৈয়দ মুজতবা আলী সড়কের পশ্চিম বাজারেছবি: প্রথম আলো

‘চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল চল চল হে/ টগবগ-উচ্ছল কাথলিতল-জল কল কল হে।’...অলক টি স্টল নামে একটি সাদামাটা চায়ের দোকানে যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙ্‌ক্তি হুট করে মনে পড়ে যায়। দোকানের ভেতরে–বাইরে চা–প্রেমীদের ভিড়, আগুনের চুলায় কেটলিতে বলক দেওয়া পানি, কাপ-চামচের টুংটাং শব্দ আর নানাজনের নানা রকমের ব্যস্ততায় ভরপুর এই দোকান।

মৌলভীবাজার শহরের সৈয়দ মুজতবা আলী সড়কের পশ্চিম বাজার এলাকায় এই চায়ের দোকান। মালিকের নিজের নামেই দোকানের নাম। মালিক অলক দেব (৪০) বছরখানেক আগে বর্তমান স্থানটিতে ‘অলক টি স্টল’ চালু করেছেন। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এই স্টলে প্রায় দেড় হাজার কাপ দুধ ও রং চা বিক্রি হয়।

সম্প্রতি অলক টি স্টলে গিয়ে দেখা যায়, দোকানটির ভেতরে ও বাইরে চা–প্রেমীদের উপচে পড়া ভিড়। সড়কের একটা অংশজুড়ে সারি করে রাখা মোটরসাইকেল। কেউ হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মোটরসাইকেলে হেলান দিয়ে, কেউ–বা দাঁড়িয়ে চা পান করছেন আর গল্প করছেন। চা পান শেষে মোটরসাইকেল নিয়ে সরে গেলে, অন্য মোটরসাইকেল এসে খালি জায়গাটি পূরণ করে ফেলছে। অনেকে চা তৈরির স্থানটি গোল হয়ে ঘিরে রেখেছেন। কে কার আগে কাপ নিয়ে যাবেন, এ নিয়ে রীতিমতো হুলুস্থুল অবস্থা। এই ভিড়ের মধ্যে ভেসে আসছে মানুষের কথাবার্তা, কাপ ও চামচের টুংটাং শব্দ।

দোকানের ঘর, বারান্দা ও সড়ক—সবখানেই মানুষের ভিড়। এত সব বিচিত্র মানুষ, মানুষের তাগাদা এক হাতেই সামাল দিচ্ছেন অলক। কখনো কেটলি থেকে চায়ের কাপে পানি ঢালছেন, কখনো বয়াম থেকে পাতা বা চিনি নিচ্ছেন। কাঁচা আদার টুকরা ও লবণ ছড়িয়ে দিচ্ছেন কাপে। সঙ্গে চা–প্রেমী ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলা, টাকা নেওয়া—সবটাই হাসিমুখে যন্ত্রের মতো পালন করছেন।

চা পান করতে আসা শৈলেন রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (অলক দেব) স্বাভাবিক চা-ই বানিয়ে থাকেন। তারপরও এদিকে এলে তাঁর স্টলে এক কাপ চা খাই। আমার মতো অনেকেই আছেন। তার স্টলে সব সময় ভিড়।’

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পশ্চিম বাজার একটি বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতা অনেক। অন্য খাবারের দোকানে নানা রকম জিনিস থাকে। ক্রেতাও নানা রকম। অলক দেবের স্টলে চা-ই প্রধান। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁরা শুধু চা পান করার ইচ্ছাতেই আসেন। বাড়তি ইচ্ছা হলে হয়তো কেউ বিস্কুট বা এ–জাতীয় কিছু খেয়ে থাকেন। এ কারণে চা-ই তাঁর স্টলে বেশি বিক্রি হচ্ছে।

অলক দেব জানালেন, বর্তমান জায়গাটিতে স্টল চালুর আগে কাছেই উল্টো দিকে তাঁর দোকান ছিল। সেখানে চার-পাঁচ বছর আগে স্টল দিয়েছিলেন। তখন দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ কাপ চা বিক্রি হতো। বর্তমান জায়গাটিতে এসেছেন প্রায় এক বছর হয়েছে। ঘর ভাড়া ১১ হাজার টাকা। সকাল ১০টায় দোকান খোলেন। বন্ধ করেন রাত ১০টার বেশ পরে। সপ্তাহে শুক্রবারে দোকান বন্ধ থাকে। চারজন কর্মচারী আছেন বিভিন্ন বেতনের। এখন সারা দিনে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কাপ চা বিক্রি হয়ে থাকে। দুধ চা ও রং চা প্রতি কাপ ১০ টাকা। এই চা বিক্রি করতে দিনে দুই কেজি চা-পাতা, আট কেজি চিনি ও পাঁচ কেজি দুধ লাগে। আর কিছু বিস্কুট, টোস্ট আছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের আতুরঘর এলাকায় তাঁর বাড়ি। মা, স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে সংসার। আদা, লবণ ছাড়া চায়ের সঙ্গে অন্য কিছু মেশান না তিনি। গুণ-মান ঠিক রেখে শুধু দুধ চা ও রং চা-ই বিক্রি করেন।

আয় কত জানতে চাইলে অলক দেব বলেন, ‘মাসে কত আয় হয়, এর হিসাবটিসাব করি না। খাইয়া-বাঁচিয়া মোটামুটি ভালোভাবে চলা যায়, অউভাবেই (এইভাবেই) চলরাম।’