২০১১ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শরফপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ রবিউল ইসলাম। ওই সময় থেকেই তাঁকে ‘সতর্ক’ থাকতে বলতেন পরিবারের সদস্যরা। তবে তাতে গুরুত্ব দিতেন না রবিউল। শেষ পর্যন্ত আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন এলাকার ‘জনপ্রিয়’ এই জনপ্রতিনিধি।
নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধ ছাড়া রবিউল ইসলামের শত্রু হওয়ার মতো কেউ নেই বলে দাবি করেছেন তাঁর বড় ভাই মনজিরুল ইসলাম। আজ সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রবিউল কারও সঙ্গে কখনো ঝগড়া পর্যন্ত করেননি। সাধারণ মানুষের কাছে খুবই প্রিয় ছিলেন। রবিউলকে সতর্ক থাকার কথা বলা হলে তিনি বলেতেন, ‘আমি কারও ক্ষতি করিনি, আমাকে মারবে কে!’
গত শনিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের গুটুদিয়ার ওয়াপদা সেতুর কাছে শরফপুর ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওই সময় তিনি ডুমুরিয়া থেকে মোটরসাইকেলে করে খুলনার বাসায় ফিরছিলেন। এ ঘটনায় রবিউলের স্ত্রী শায়লা ইরিন বাদী হয়ে রোববার রাতে ডুমুরিয়া থানায় মামলা করেছেন। ওই মামলায় আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। আজ সোমবার বিকেল পর্যন্ত পুলিশও ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
রবিউল ইসলামের বাড়ি শরফপুর ইউনিয়নের ভুলবাড়িয়া গ্রামে। সোমবার ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শরফপুর ইউনিয়নের ১৮ বছরের চেয়ারম্যান ছিলেন নূরুদ্দিন আল মাসুদ। তিনি ছিলেন ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ২০১১ সালে অল্প বয়সের যুবক রবিউল ইসলামের কাছে পরাজিত হন তিনি। সেই থেকে নূরুদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে রবিউলের পরিবারের সদস্যদের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনেও হেরে যান নূরুদ্দিন। এতে দ্বন্দ্ব আরও বাড়ে। নূরুদ্দিন মারা গেলে তাঁর জায়গায় ২০২২ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন সাবেক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এইচ এম উবায়দুল্লাহ। উবায়দুল্লাহ হলেন নূরুদ্দিনের ভগ্নিপতি।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত জাতীয় সংদ নির্বাচনে রবিউল ইসলাম ছিলেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের সমর্থক। তাঁর হয়ে সরাসরি নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নেমেছিলেন। অন্যদিকে উবায়দুল্লাহ সমর্থন করেন বিদ্রোহী প্রার্থী শেখ আকরাম হোসেনকে। একইভাবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদের পক্ষে নির্বাচন করেন রবিউল। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য আজগর বিশ্বাসের পক্ষে নির্বাচন করেন উবায়দুল্লাহ। পরপর সব নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় উবায়দুল্লাহ খেপে ছিলেন রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে। সেই রাগ থেকেই রবিউল ইসলামকে খুন করা হতে পারে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী ও রবিউল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য উবায়দুল্লাহর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁর ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
রবিউল ইসলামের বড় ভাই শেখ মনজিরুল ইসলাম বলেন, ২০০৩ ও ২০০৪ সালে শুধু শরফপুর ইউনিয়নেই চারজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া গুম করা হয় আরেকজনকে। যাঁরা খুন হন, তাঁরা সবাই উঠতি নেতা ছিলেন। এসব ঘটনার কারণেই রবিউল চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই শঙ্কা ছিল যেকোনো সময় হয়তো তাঁকেও খুন করা হতে পারে। ২০১৪ সালে খুলনা নগরের বাবুখান রোডে খুন হন রবিউল ইসলামের একনিষ্ঠ সমর্থক জাকির হোসেন। এতে শঙ্কা আরও বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে বারবার রবিউলকে সতর্কও করা হয়েছিল।
ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত সাহা প্রথম আলোকে বলেন, রবিউল হত্যা মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করা না হলেও সন্দেহজনকভাবে কয়েকজনের কথা বলা হয়েছে। সেই সূত্র ধরেই বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে। আশা করা যায় দ্রুত সময়ের মধ্যে ভালো কোনো ফল পাওয়া যাবে।
জেলা আওয়ামী লীগ নেতাকে আটকের অভিযোগ
এদিকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য আজগর বিশ্বাসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার দুপুরের দিকে নগরের রায়েরমহল এলাকায় নিজ কার্যালয় থেকে জেলা ডিবি পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন আজগর বিশ্বাসের ছোট ভাই তারেক বিশ্বাস।
আজগর বিশ্বাস ‘বিশ্বাস প্রোপার্টিজ’ নামের একটি আবাসন প্রকল্পের মালিক। তিনি এবার ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। গত জুন মাসে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
আজগর বিশ্বাসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে খুলনা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান বলেন, ‘এসব ব্যাপারে পরে আপনাদের জানানো হবে। যদি কেউ তুলে নিয়ে যায়, তাহলে খোঁজ নিয়ে আপনাদের জানাব।’
এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল
রবিউল ইসলামের খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন এলাকাবাসী। শনিবার রাতে খুন হওয়ার পর গতকাল রোববার দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। আজ সোমবার বিকেলেও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তাঁরা। ওই মিছিল থেকে রবিউল ইসলামের খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে ফাঁসি নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।