পংকজ নাথের কবজা থেকে চরের জমি উদ্ধারের দাবিতে মানববন্ধন, নানা বিতর্ক

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের মেঘনা তীরের চরের জমি ফিরে পেতে যুবদল নেতার নেতৃত্বে মানববন্ধন। আজ সোমবার দুপুরে উলানিয়া বাজারের টেম্পুস্ট্যান্ড এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) পংকজ নাথসহ তাঁর অনুসারীদের হাত থেকে চরের জমি উদ্ধারের দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে। মেহেন্দীগঞ্জের দুর্গম চরাঞ্চলের জমির মালিক ও কৃষকেরা আজ সোমবার দুপুরে উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের উলানিয়া টেম্পুস্ট্যান্ডে এই মানববন্ধন করেন।

এই মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন গোবিন্দপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মিজানুর রহমান মাঝি এবং ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি লুৎফর রহমান তালুকদার। এ সময় ভুক্তভোগী কৃষকেরা এক ঘণ্টা ধরে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ‘দলিল যার, জমি তার’ স্লোগান লেখা ফেস্টুন হাতে মানববন্ধনে অংশ নেন।

এদিকে স্থানীয় বিএনপির একাংশের নেতারা অভিযোগ করেছেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব চরের অনেক জমি যুবদল নেতা মিজানুর রহমান ও উপজেলা বিএনপির কতিপয় নেতা দখল করার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে ধামাচাপা দিতে মানববন্ধন করানো হয়েছে।

মানববন্ধনে অংশ নেওয়া কৃষকেরা জানান, মেঘনার অপর পারে গোবিন্দপুর নতুনচরের প্রায় ১৪ হাজার একর জমি রয়েছে। এসব জমি ৩০ বছর আগে মেঘনা নদীতে ভেঙে যায়। বছর বিশেক আগে নতুন চর পড়ে। এসব জমির বেশির ভাগ চাষাবাদের উপযোগী হওয়ায় আওয়ামী লীগের লোকজন তা দখলে নেন। কিন্তু এই জমির প্রকৃত মালিক নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলো। স্থানীয় কিছু কৃষক জমি চাষাবাদ করলেও আওয়ামী লীগের চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা জোর করে সেসব জমির ফসল কেটে নিয়ে যান। গরিব কৃষকেরা এসব ভূমিদস্যুদের বাধা দিতে গেলে অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করতেন। আবার বেশি বাড়াবাড়ি করলে হত্যার হুমকি দিতেন। প্রাণভয়ে ওই সব সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ও বাধা দিতেও ভয় পেতেন অসহায় কৃষকেরা।

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের মেঘনা তীরের চরের জমি ফিরে পেতে যুবদল নেতার নেতৃত্বে মানববন্ধন। আজ সোমবার দুপুরে উলানিয়া বাজারের টেম্পুস্ট্যান্ড এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

গোবিন্দপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, প্রায় ১৫ হাজার একর জমি দখল এবং ফসল লুট করার অভিযোগ রয়েছে সাবেক এমপি পংকজ নাথ এবং তাঁর অনুসারী গোবিন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত আলতাফ হোসেন সরদার ও তাঁর ছেলে তারেক সরদার, সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন তালুকদার, খবির সিকদার, কামাল হাওলাদার, আবদুল রশিদ, হাশেম কারিগর ও নওশাদ সিকদারের বিরুদ্ধে। ভূমিদস্যুদের কবল থেকে জমি ও জমির ফসল রক্ষার জন্য তাঁরা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

এ বিষয়ে গোবিন্দপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, এই চর ঘিরে বছরে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা অবৈধ আয় হয়। এর মধ্যে চরে বাগদা চিংড়ির রেণু ধরায় প্রতিবছর ৪৫ থেকে ৫০ লাখ, মহিষ চড়ানোর জন্য ৪৪ থেকে ৫০ লাখ, চাই দিয়ে মাছ ধরায় ৪০ লাখ, ফসল ফলানোসহ বিভিন্ন খাতে এই অর্থ আদায় হয়। আগে চরটি আওয়ামী লীগের লোকেরা দখল করে আধিপত্য করতেন। ৫ আগস্টের পর বিএনপির লোকেরা এই আধিপত্য বিস্তার করেন। মূলত সাধারণ কৃষকদের জমি বুঝিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে এই মানববন্ধন করা হয়েছে। এটা চরে আধিপত্য বজায় রাখার কৌশল ছাড়া আর কিছুই না।

বরিশাল-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মেজবা উদ্দিন ফরহাদ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন দলীয় নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এসব জমি দখল, মাছঘাট, লঞ্চ ও খেয়াঘাট করার অভিযোগ ওঠা নিয়ে দলে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এখন কৃষকদের এনে এই ঘটনা ধামাচাপা দিতেই এই মানববন্ধন করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে যুবদল নেতা মিজানুর রহমান মাঝি বলেন, ‘৩০ বছর আগে আমার দাদা ও নানার বাড়িঘর ও বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি মেঘনার গর্ভে চলে যায়। এরপর বছর কুড়ি আগে ওই চর জেগে ওঠে। এরপর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ ও তাঁর লোকজন এই জমি জোর করে ভোগদখল করে আসছেন। কিন্তু এখানে আমার দাদা-নানার ২০০ থেকে ৩০০ একর জমি রয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক অনেকের জমি রয়েছে। আমরা এখন এই জমি বৈধ প্রক্রিয়ায় দখলে যেতে চাই।’

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাজীব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই জমি সিকস্তি (ভাঙনে বিলীন)। তাই এর খাজনা নেওয়া বন্ধ। এ জন্য এ জমি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত বা সরকারি। যদি নদীতে বিলীন হওয়া এই জমি ২৫ বছরের মধ্যে জেগে ওঠে, তাহলে মালিকেরা আইনত এ জমির মালিক। সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে আগে এই জমি পয়োস্তি (জেগে ওঠা) হলে সেটা জরিপ করে, যাচাই-বাছাই করে পরে প্রকৃত মালিকদের বণ্টন করার নিয়ম রয়েছে।

রাজীব হোসেন বলেন, ‘অচিরেই এই জমি জরিপ করব এবং এরপর দেখব দাবি করা ব্যক্তিরা আসলে জমির মালিক কি না। যাঁরা মানববন্ধন করেছেন, তাঁরা কখনোই মালিকানা দাবি করে আমার কাছে আসেননি।’