চারদিকে পানি আর পানি। তবে খাওয়ার মতো পানি নেই। খাওয়ার পানির উৎস পুকুরগুলো লোনাপানিতে ভরে গেছে। উচ্চ জোয়ারে ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। ঘরের মধ্যেই কোমরসমান পানি। ভেঙে পড়েছে মাটির ঘর। রান্না করার কোনো জায়গা নেই, নেই কোনো শৌচাগারও। এই চিত্র খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১৩টি গ্রামের।
বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি, খাদ্যসামগ্রী ও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থায় না থাকায় গ্রামগুলোর মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গ্রামগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ২২ নম্বর পোল্ডারের মধ্যে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে তেলিখালী গ্রামে ভদ্রা নদীর বাঁধ ভেঙে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ১৩ গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ভাসছে তারা। গত রোববার রাত থেকে এখনো এক বেলা ভালো করে খাওয়া জোটেনি গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষের। সবকিছু হারিয়ে সম্বল এখন শুধু চোখের পানি। কথা বলতে গেলেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন এসব গ্রামের বাসিন্দারা। সাজানো-গোছানো সংসার তছনছ হয়ে যাওয়ার দুঃখ কোনোভাবেই যেন চাপা দিতে পারছেন না তাঁরা।
ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া গ্রামগুলো হচ্ছে–তেলিখালী, গোপিপাগলা, ফুলবাড়ি, বিগরদানা, দূর্গাপুর, সৈয়দখালী, খেজুরতলা, সেনের বেড়, হাটবাটি, কালীনগর, হরিণখোলা, দারুলমল্লিক ও নলডাঙ্গা।
চারদিকে পানি থাকায় ওই ১৩ গ্রামের মানুষ গবাদিপশু, হাস-মুরগি নিয়েও বিপাকে পড়েছেন। লোনাপানির কারণে গবাদিপশুর খাবারও নষ্ট হয়ে গেছে। রাখার জায়গা না থাকায় গরু-ছাগল বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেকে, কেউ কেউ রেখে আসছেন অন্য গ্রামে। পানিতে ভাসছে মরা মাছ। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় এলাকায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এলাকাবাসী বলছেন, ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, আম্পান, ইয়াসের মতো বড় বড় ঘূর্ণিঝড় গেলেও তাঁরা কখনো এমন বিপদে পড়েননি, আশ্রয়হীনও হতে হয়নি। তবে এবার পানির তোড়ে ভেসে গেছে অধিকাংশ আসবাব ও ঘরের অন্য মালামাল। এবার তরমুজ চাষ করে যে টাকা ঘরে রেখেছিলেন, মুহূর্তের মধ্যেই তা পানিতে ভেসে গেছে।
গত সোমবার সকাল থেকে বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন এলাকাবাসী। আজ বুধবার সকালে বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু করে পানি পাউবো। ওই কাজে হাত লাগিয়েছিলেন এক হাজারের বেশি গ্রামবাসী। তবে আজও জোয়ারের আগে পানি আটকাতে পারেননি তাঁরা। বেলা দেড়টার দিকে জোয়ারের পানি ভরতে শুরু করলে কাজ ছেড়ে দেওয়া হয়। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকালে আবারও বাঁধ মেরামতে নামবেন এলাকাবাসী।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ২২ নম্বর পোল্ডার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঘর থেকে আসবাব, কাপড়, রান্না করার হাঁড়িপাতিল নিয়ে সড়কের ওপরে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন অনেকে। বাঁশ, খুঁটি, পলিথিন দিয়ে সড়কের ওপরে কোনো রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করছেন তাঁরা। ভেজা কাপড় সড়ক ও পাশের বেড়ায় শুকাতে দিয়েছেন। গরু-ছাগল নিয়ে যাচ্ছেন পাশের গ্রামে বা স্বজনের বাড়িতে। অধিকাংশ পুরুষ গেছেন বাঁধ মেরামতের কাজে অংশ নিতে। গ্রামগুলোর যত দূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। লোনাপানির প্রভাবে ইতিমধ্যে কিছু গাছপালাও মরতে শুরু করেছে।
গোপীপাগলা গ্রামে সড়কের পাশে গৃহস্থালি সামগ্রী রেখে পলিথিন দিয়ে কোনো রকম থাকার জায়গা তৈরি করছিলেন কল্যাণী সরদার ও তাঁর স্বামী লাল্টু সরদার। কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলেন কল্যাণী। তিনি বলেন, ‘রোববার রাত তিনটার দিকে দেখি, শোঁ শোঁ করে পানির শব্দ হচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরের মধ্যে খাটের সমান পানি চলে আসে। তড়িঘড়ি করে আসবাব গুছিয়ে রাখতে গিয়েও তা সম্ভব হয়নি। অধিকাংশই পানির তোড়ে ভেসে গেছে। কোনো রকম জান নিয়ে রাতে রাস্তায় চলে আসি। সকালের দিকে বাড়ি গিয়ে দেখি, ঘর ভেঙে পড়েছে। সেই রাত থেকে সড়কের ওপরে আছি। গত দুই দিন ভাতও খেতে পারিনি। কোনো সরকারি সাহায্যও এখনো পাইনি।’
বাঁধের ভেঙে যাওয়া স্থানে কথা হয় তেলিখালী গ্রামের অংশুপতি মল্লিকের সঙ্গে। ভোর থেকে বাঁধ মেরামতে শ্রম দিয়েছেন। কাজ শেষ করে শুকনা মুড়ি চিবাচ্ছিলেন। অংশুপতির ১০ বিঘা আয়তনের ৩টি ঘের ছিল। ঝড়ের প্রথম দিনেই ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। ঘর ভেঙে পড়েছে তাঁর। পরিবার নিয়ে আছেন পাশের এক পাকা বাড়িতে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ‘সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন করে আবার শুরু করতে হবে। এলাকার মানুষ কবে এই দুঃখ কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারবে, তা শুধু সৃষ্টিকর্তাই জানেন।’
বাঁধ সংস্কারের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের পানি দিয়ে সহযোগিতা করছিলেন বিগরদানা গ্রামের দীপিকা সরদার। হাতে দুটি জগ ও গ্লাস নিয়ে হেঁটে বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। দীপিকা বলেন, ‘অন্যান্য উপকূলীয় এলাকার মতো এই এলাকায় লবণাক্ততার প্রভাব খুব বেশি ছিল না। পুরো পোল্ডারটি ছিল মিষ্টি পানির আধার। লবণপানি ঢুকে সেই আধার নষ্ট হয়ে গেছে। আগামী ১০ বছরেও হয়তো এলাকা আর স্বাভাবিক হতে পারবে না।’
এই বিষয়ে দেলুটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিপন কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পোল্ডারটি লোনাপানিমুক্ত ছিল। কিন্তু বাঁধ ভেঙে পুরো এলাকা সাগরের লোনাপানিতে প্লাবিত হয়েছে। এখন কৃষি ও মাছ চাষে ব্যাপক সমস্যা দেখা দেবে। দুর্গত মানুষকে খাদ্যসহায়তা দিতে উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।’
দেলুটি ইউনিয়নটি পড়েছে খুলনা পাউবো সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ-২–এর আওতায়। ওই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ২২ নম্বর পোল্ডারের আয়তন প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর। ভদ্রা নদীর ২৫০ মিটারের মতো ভেঙে পোল্ডারটি পুরোপুরি লবণপানিতে ভেসে গেছে। সাধারণত পোল্ডারের যেকোনো একপাশ ভাঙলে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়। ভাঙন এলাকায় রিংবাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।