মদনপুর-আড়াইহাজার সড়কের প্রভাকরদী বাজার থেকে সোনারগাঁয়ের মৃত ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের বাড়ির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। আজ মঙ্গলবার দুপুরে প্রভাকরদী বাজারে গিয়ে রিকশাচালকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘কেউ নুরুল ইসলামের বাড়ি চেনেন কি না!’ মহিউদ্দিন নামের এক চালক পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কোন নুরুল ইসলাম, পুলিশ যে পিডাইয়া মাইরা ফেলছে হেই নুরু?’
তিন কিলোমিটার দূরের প্রভাকরদী বাজারে জানাজানি হয়েছে যে পুলিশের মারধরে পোলট্রি ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর নুরুল ইসলামের দুই মেয়ে শিলা আক্তার ও মিথিলা আক্তারও গত সোমবার রাতে প্রথম আলোর কাছে একই অভিযোগ করেন।
তবে পুলিশের দাবি, নুরুল মাদক ব্যবসায়ী। আগে থেকেই অসুস্থ নুরুলের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু নিয়ে পরিবারের কোনো অভিযোগ না থাকায় বিনা ময়নাতদন্তে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে পুলিশ নিজ থেকে নুরুল ইসলামের বাড়িতে যাওয়া তিন পুলিশ সদস্যকে তাঁদের কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপে মীমাংসা করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
নুরুল ইসলামের বাড়ি সোনারগাঁয়ের জামপুর ইউনিয়নের বুরুমদী মধ্যপাড়া এলাকায়। গ্রামীণ সড়কের পাশে একতলা পাকা ভবন। ছেলে নেই, পাঁচ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রীর সঙ্গে সেই বাড়িতেই থাকতেন নুরুল ইসলাম।
আজ দুপুরে নুরুল ইসলামের বাড়িতে গেলে তাঁর দুই মেয়ে শিল্পী আক্তার, সোমা আক্তার ও জামাতা মো. হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়। সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বলার আগেই শিল্পী হাতজোড় করে বলতে থাকেন, ‘বাবার স্বাভাবিক মৃত্যু হইসে। কারও বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নাই। প্লিজ আপনারা চলে যান।’ সোমবার পুলিশের বিরুদ্ধে করা তাঁদের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্পী কথা বলেন না। পরে তাঁর বোন সোমা আক্তার হাতজোড় করে বলেন, ‘আমরা মীমাংসা করে ফেলসি। আমাদের আর কিছু জিজ্ঞাসা কইরেন না।’
যা বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা
নিহত নুরুল ইসলাম এলাকায় পোলট্রি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যুক্ত ছিলেন জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত ১০ জন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, নুরুল ইসলাম একসময় মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিন বছর আগে তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। এরপর থেকে তাঁর মাদকসংশ্লিষ্টতার কোনো খবর আর এলাকাবাসী জানেন না। তালতলা পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা প্রায় সময়ই নুরুল ইসলামের বাড়িতে আসতেন। সোমবার বেলা তিনটার দিকে ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ইলিয়াস আহমেদ, কনস্টেবল আবুল কালাম ও রুকনুজ্জামান সাদা পোশাকে ওই বাড়িতে যান। কিছু সময় পর নুরুলের বাড়িতে চিৎকার–চেঁচামেচি শোনা যায়। চিৎকার শুনে নুরুলের ছোট ভাই শামসুল ইসলাম ও প্রতিবেশী এস এম ইমরান আরও অনেকের সঙ্গে নুরুলের বাড়িতে যান।
শামসুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এএসআই ইলিয়াসকে আগে থেকেই চিনি। বাড়িতে গিয়ে দেখলাম ভাইয়ের হাতে হাতকড়া। ওনার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি তাঁকে (এএসআই ইলিয়াস) গিয়ে বললাম, “ভাই হার্টের রোগী। আপনি তো আমাদেরই লোক। এমন করলে ভালো দেখায় না। মারধর কইরেন না।” এ কথা বলতেই ইলিয়াস আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পরে আমি সেখান থেকে বাজারে চলে যাই। এর কিছুক্ষণ পরই ফোনে জানতে পারি, পুলিশের মারধরে ভাই মারা গেছেন।’
বাড়ির পাশের সড়কে বসে ভাইয়ের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে চোখ মুছতে মুছতে শামসুল বলেন, ‘এগুলো এখন বলতে গেলে বিপদ। এ দেশে তো বিচার নাই। আমরা আল্লার কাছে বিচার দিসি।’
শামসুলের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানেই ছিলেন তাঁর আত্মীয় দেলোয়ার হোসেন ও প্রতিবেশী কৃষক এস এম ইমরান। এই প্রতিবেদকের কাছে সোমবারের ঘটনার আদ্যোপান্ত বলেন ইমরান। জানান, একসময় নুরুল ইসলাম মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন থেকেই পুলিশ তাঁর বাড়িতে আসে। তারপর টাকা দিলে চলে যায়। সোমবারও টাকা নিতেই পুলিশ নুরুল ইসলামের বাড়িতে এসেছিল বলে তাঁর ধারণা।
তার আগে সোমবার রাতে নুরুলের দুই মেয়ে জানিয়েছিলেন, ধস্তাধস্তির সময় পুলিশ নুরুলকে কিল-ঘুষি ও লাঠি দিয়ে নুরুলের বুকে আঘাত করে। পেছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরে চাপ দেয়। তখন তিনি পুলিশের কাছে ইনহেলার ও পানি চান। পুলিশ ইনহেলার ও পানি না দিলে সেখানেই নুরুলের মৃত্যু হয়। পরে তাঁকে আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আশরাফুল আমিন জানান, সোমবার বিকেল পৌনে পাঁচটায় নুরুলকে হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর কারণ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি।
দুই পুলিশ সদস্য ৩ ঘণ্টা অবরুদ্ধ
নুরুলের স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, নুরুলকে রেখে পুলিশ চলে যাওয়ার পর অভিযুক্ত দুই পুলিশ সদস্য নুরুলের মৃত্যুর খবর শোনেন আবার ঘটনাস্থলে আসেন। এ সময় ক্ষুব্ধ স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাঁদের একটি ঘরে অবরুদ্ধ করে রাখেন। প্রায় তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ রাখার পর সন্ধ্যা সাতটার দিকে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ-অঞ্চল) শেখ বিল্লাল হোসেন ও সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাবুব আলম ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করেন।
সংসদ সদস্য যাওয়ার পর বদলে যায় সব
স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাতে জানা যায়, পুলিশের মারধরে নুরুল ইসলামের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার লোকজন ও নিহতের স্বজনেরা নুরুলের বাড়িতে ভিড় জমান। তাঁরা পুলিশের ওপর মারমুখী হয়ে ওঠেন। রাত আটটার দিকে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন ঘটনাস্থলে যান। সংসদ সদস্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দরজা বন্ধ করে বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে সংসদ সদস্য উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বলেন, নুরুলের মৃত্যু নিয়ে তাঁর পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই। বিনা ময়নাতদন্তে নুরুলের মরদেহ দাফন করা হবে। এখন থেকে নুরুলের পরিবারের দায়িত্ব তিনি নিলেন। সংসদ সদস্যের এমন কথার পর ক্ষুব্ধ স্বজন ও প্রতিবেশীরা নুরুলের বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। নুরুলের স্বজনেরা বলেন, সংসদ সদস্যের এমন কথার পর সবকিছু পাল্টে যায়। তাঁরা আর এ ঘটনায় কোনো অভিযোগ করার সাহস করেননি। এমনকি ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের সিদ্ধান্ত নেন। তবে এ বিষয়ে সংসদ সদস্যের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর ব্যবহৃত তিনটি মুঠোফোন নম্বরে ফোন করা হলে সব কটিরই সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।
মামলা হয়নি, তিন পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার
নুরুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় আজ রাত ৯টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে ওই বাড়িতে যাওয়া তিন পুলিশ সদস্যকে পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব তথ্য নিশ্চিত করে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) চাইলাউ মারমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের এএসআই ইলিয়াস আহমেদ ও তাঁর সঙ্গে থাকা কনস্টেবল আবুল কালাম ও রুকনুজ্জামানের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখছি। আপাতত তাঁদের প্রত্যাহার করা হয়েছে।’
মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মাদক উদ্ধারের জন্য পুলিশ সেই বাড়িতে অভিযান চালায়। মাদক না পেয়ে তারা বাড়ি থেকে চলে এলে জানা যায়, আগে থেকেই অসুস্থ নুরুল ইসলাম মারা গেছেন। পরিবারের কোনো অভিযোগ না থাকায় এবং বিনা ময়নাতদন্তে লাশ দাফনের আবেদনের পর পুলিশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দেয়।