‘ছাত্রগো ওপরে গুলি, অত্যাচার দেইখ্যা ছুইট্টা গেছি, আইজ আমার জীবনটাই অন্ধকার’

মা হনুফা বেগমের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাবার বুলেটে চোখ হারানো বেল্লাল হোসেন। সম্প্রতি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের কয়া বাজার গ্রামেছবি: প্রথম আলো

জীবনটা ষোলো আনাই মিছে মনে করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাবার বুলেটবিদ্ধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক বেল্লাল হোসেন। তাঁর আয়ের ওপরই সংসার চলছিল। কিন্তু এখন দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসায় তাঁর সেই আয়ের পথ বন্ধ। পরিবারের ছয় সদস্যের ক্ষুধার্ত ও অসহায় অবস্থা দেখে তিনি আরও মুষড়ে পড়েছেন। আলাপকালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেল্লাল হোসেন বললেন, ‘জীবনটা শ্যাষ অইয়্যা গ্যালো।’

বেল্লাল হোসেনের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের কয়া বাজার গ্রামে। নিজেদের সামান্য জমিতে ছোট টিনের ঘরেই পরিবার নিয়ে তাঁর বসবাস। গত ১৪ নভেম্বর সকালে বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। এ সময় বেল্লাল বলেন, ‘পরিবার, নিজের জীবন কোনোডাই ভাবি নাই। অসহায় ছাত্রগো ওপরে গুলি, অত্যাচার দেইখ্যা ছুইট্টা গেছি, আইজ আমার জীবনটাই অন্ধকার, অচল। এহন আমি সবারই বোঝা, একলা চলতে পারি না। কী অইবে, ক্যামনে চলমু কিচ্ছু কইতে পারি না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি ও লাঠিপেটায় শিক্ষার্থীরা জীবন বাঁচাতে দিগবিদিক ছুটছিলেন। মাইকিং করে এলাকাবাসীর সহযোগিতা চান শিক্ষার্থীরা। তখন অটোরিকশা চালিয়ে বরিশাল নগরের দিকে যাচ্ছিলেন বেল্লাল হোসেন। শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সড়কের পাশে অটোরিকশা ফেলে তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে যান তিনি। এ সময় পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট তাঁর পিঠ ও চোখে লাগে। একপর্যায়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে হাসপাতালে পাঠান। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে চক্ষু হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসা হলেও একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর। আরেকটি চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখছেন।

বেল্লাল হোসেনের ভাষ্য, ঢাকার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল চিকিৎসকেরা তাঁকে জানিয়েছেন, ডান চোখটি ভালো করতে হলে উন্নত চিকিৎসা দরকার। সে চিকিৎসা দেশে নেই। বিদেশে যেতে হবে। আক্ষেপ করে বেল্লাল বললেন, ‘দ্যাশেই চিকিৎসা করাইতে পারি না, হ্যারপর বিদাশ।’

স্বজন ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, বেল্লালের বয়স যখন ১০ বছর। তখন তাঁর বাবা তৈয়ব আলী হাওলাদার মারা যান। এরপর মা হনুফা বেগম ও ভাইকে নিয়ে সংসারের হাল ধরতে হয় বিল্লালকে। বছর দুয়েক আগে বিয়ে করেছেন তিনি। স্ত্রী সাদিয়া সম্প্রতি মা হয়েছেন। দেড় মাস বয়সী মেয়ে সুমাইয়াসহ এখন তাঁর পরিবার সদস্যসংখ্যা ৬। টানাপোড়েনের মধ্যেই সংসারটা চালিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু এখন অচল হয়ে সংসার আর টেনে নেওয়ার ক্ষমতা আর অবশিষ্ট নেই। এমন দুঃসময়ের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তাও পাননি বেল্লাল। স্থানীয়ভাবে যে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন, তা দিয়ে পরিবার কোনোরকমে চলছে। কিন্তু এরপর কী হবে—তা নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়।

ছেলের এমন অবস্থায় মা হনুফা বেগম পড়েছেন বিপাকে। সংসার কীভাবে চলবে, ছেলে, ছেলের বউ ও ছোট নাতনির ভবিষ্যতে কী হবে, কীভাবে বাঁচবে, সেই চিন্তায় ঘুমাতে পারেন না হনুফা বেগম। তিনি বলেন, ‘সোংসারডা তো এত দিন বেল্লালের উফরেই চলত। এহন আর চলে না। বেল্লালরে যেন কেউ স্থায়ী কিছু কইর‌্যা দেয়, যাতে মোরা খাইয়্যা, পইর‌্যা বাঁচতে পারি।’

বেল্লালকে চিকিৎসার জন্য এখন মাসে একবার, আবার কখনো দুবার ঢাকায় যেতে হয়। সঙ্গে একজনকে নিয়ে ঢাকায় যাওয়া-আসা করতে চার-পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এক চোখ দিয়ে দেখার মতো সক্ষম করতে হলে বিদেশে চিকিৎসা লাগবে। কিন্তু সেই অর্থ তো তাঁর নেই। প্রথম দিকে সবাই খোঁজখবর নিতেন। এখন তা কমে গেছে। বেল্লাল বলেন, ‘বিপদের সময় এক দিন, দুই দিন মানষে জিগায়, তিন দিন পর আর কেউ খোঁজ রাহে না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সুজয় শুভ প্রথম আলোকে বলেন, বেল্লাল হোসেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ তাঁর জীবনই অচল। তাঁরা স্থানীয়ভাবে যত দূর সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর উন্নত চিকিৎসা দরকার, সেই সঙ্গে পরিবার চালাতে হলে স্থায়ী কিছু করা প্রয়োজন।