যশোরে বাসাবাড়ির পাম্পে ৩০০ টাকা ফির সিদ্ধান্তে পৌরসভা ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা
যশোরে পৌরসভার সরবরাহ করা পানির পাশাপাশি বাসাবাড়িতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নলকূপ (সাবমার্সিবল পাম্প) বসিয়ে পানি তুলছেন অনেকে। পৌর কর্তৃপক্ষ জরিপ চালিয়ে সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহারকারী ১১ হাজার বাড়ির মালিক শনাক্ত করেছে। এবার সাবমার্সিবল পাম্প বাবদ প্রতি মাসে ৩০০ টাকা অতিরিক্ত বিল আদায়ের নোটিশ জারি করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
পৌর কর্তৃপক্ষের এই নোটিশ জারির প্রতিবাদে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে আজ বুধবার যশোর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সভা করা হয়েছে। ওই সভা থেকে আগামী ২৯ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় পৌরসভা ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যবসায়ী শওকত আলী ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
যশোর পৌর নাগরিক সমাজের যুগ্ম আহ্বায়ক জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৌর কর্তৃপক্ষ নিয়মিত নাগরিক কর নেয়। তার মধ্যে ১০ শতাংশ থাকে পানিকর। এ ছাড়া সরবরাহ করা পানি বাবদ মাসে প্রায় ৩০০ টাকা করে বিল নেয়। কিন্তু আমরা ঠিকমতো পানি পাই না। বাধ্য হয়ে নিজস্ব খরচে সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন করেছি। সেই সাবমার্সিবল পাম্প বাবদ প্রতি মাসে ৩০০ টাকা ফি ধার্য করেছে পৌরসভা। এটা একই মুরগি তিনবার জবাই দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।’
জানতে চাইলে যশোর পৌরসভার মেয়র হায়দার গণি খান বলেন, ‘পৌরসভার পাইপলাইনে পানি সরবরাহে যে পরিমাণ খরচ, সেই পরিমাণ টাকা নাগরিকদের কাছ থেকে আদায় করা হয় না। ভর্তুকি দিয়ে পাম্প পরিচালনা করা হয়। মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়টি জানানো হয়েছে। ভর্তুকির ওই টাকা মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া গেলে সাবমার্সিবল পাম্প বাবদ প্রতি মাসে ৩০০ টাকা আদায় করা হবে না।’
যশোর পৌরসভা জরিপ চালিয়ে সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহারকারী ১১ হাজার বাড়ির মালিক শনাক্ত করেছে। সাবমার্সিবল পাম্প বাবদ প্রতি মাসে ৩০০ টাকা অতিরিক্ত বিল আদায়ের নোটিশ জারি করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে ২৯ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় পৌরসভা ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেছে নাগরিক সমাজ।
পৌরসভা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোর পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে পাইপলাইনে সরবরাহ করা পানি ব্যবহার করছে ১৫ হাজার পরিবার। প্রতিদিনের পানির চাহিদা ২ কোটি ৪৪ লাখ ২০ হাজার লিটার। চাহিদার বিপরীতে ২৯টি পাম্প দিয়ে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে ২ কোটি ১১ লাখ লিটার। অর্থাৎ প্রতিদিন ৩৩ লাখ লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ঘাটতি আরও বাড়ে। পাম্পগুলোর মধ্যে অধিকাংশ আবার অকেজো পড়ে রয়েছে। প্রতিবছরই গ্রীষ্মকালে তীব্র পানির সংকট দেখা দেয় পৌর এলাকায়। এ ছাড়া বাসিন্দাদের অভিযোগ, পৌরসভার পাইপলাইনের পানিতে দুর্গন্ধ। পানযোগ্য তো নয়ই, গৃহস্থালির কাজেও এই পানি ব্যবহার অনুপযোগী। যে কারণে পৌরবাসী নিজস্ব উদ্যোগে সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন করে পানির চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন।
পৌর কর্তৃপক্ষ জরিপ চালিয়ে সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহারকারী ১১ হাজার বাড়ির মালিক শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে তিন হাজার বাড়ির মালিককে পাম্প ব্যবহার বাবদ প্রতি মাসে ৩০০ টাকা হারে পরিশোধের জন্য নোটিশ দিয়েছে। ২০২৩ সালের ২২ মার্চ পৌরসভার মাসিক সভার সিদ্ধান্তের আলোকে এই নোটিশ দেওয়া হলেও এ বছর তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি পৌর মেয়র হায়দার গণি খান স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘স্থানীয় সরকার বিভাগের পৌরসভার পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা, ২০২৩ মোতাবেক, যেখানে পৌরসভা কর্তৃক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে পৌর পরিষদের অনুমোদন ব্যতীত অন্য কোনো উৎস থেকে পানির সংযোগ গ্রহণ করা যাবে না। সেই কারণে ২০২৩ সালের ২২ মার্চ পৌর পরিষদের মাসিক সভায় যশোর পৌর এলাকায় বাসাবাড়ি বা অন্য ভবনে স্থাপিত সাবমার্সিবল পাম্পের জন্য ভবনমালিককে মাসিক ৩০০ টাকা বিল পরিশোধ করতে হবে।’
এই চিঠি বাড়ির মালিকদের হাতে পৌঁছানোর পর তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে যশোর শহরের বাসিন্দা ও সংস্কৃতিকর্মী নওরোজ আলম খান বলেন, ‘পৌরসভার নিয়মিত পৌর কর পরিশোধ করি। পৌরসভার সাপ্লাই পানিতে দুর্গন্ধ। ঠিকমতো পানি পাওয়া যায় না। পেলেও খাওয়া ও ব্যবহার করা অনিরাপদ। এমন পরিস্থিতিতে আবার নতুন করে সাবমার্সিবল বিল জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। এটা চাঁদাবাজির শামিল।’
শহরের শংকরপুর গোলপাতা এলাকার একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, পৌরসভার সরবরাহ করা পানিতে ময়লা আসে। মাঝেমধ্যে ট্যাপ থেকে হলুদ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি পড়ে। প্রতি সপ্তাহে ট্যাংক পরিষ্কার করতে পরিষ্কারক কিনতে হচ্ছে। তাও ট্যাংক পরিষ্কার রাখা যায় না। দু-এক মাস পরপর মিস্ত্রি ডেকে বাড়ির পানির পাইপ পরিষ্কার করতে চলে যায় ৫০০ টাকা। পাইপ পরিষ্কার করলে প্রচুর ময়লা বের হয়। মাত্রাতিরিক্ত আয়রনের কারণে ওই পানি দিয়ে কাপড় ধোয়ার পর হলুদ হয়ে যায়। কলস ও বোতলে পানি রাখলে দু-এক দিনের মধ্যে কালচে রং ধারণ করে।
এ বিষয়ে যশোর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শরীফ হাসান বলেন, ‘পৌরসভা থেকে পানি নেওয়া বাধ্যতামূলক। অন্য কোনো উৎস থেকে পানি নিলে ফি দিতে হবে, এটাই আইনে আছে। এটা শুধু যশোর পৌরসভা নয়, সব পৌরসভার জন্য প্রযোজ্য। যশোর পৌরসভা অনেক দেরিতে সাবমার্সিবল পাম্প বিল আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে।’
নাগরিকদের নিরাপদ পানির চাহিদা পূরণ করা পৌর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব, সেটা নিশ্চিত করতে পারছেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু যশোর পৌরসভা না, দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা পাইপলাইনের পানির শতভাগ নিরাপদ নয়। মাটির নিচে দিয়ে পাইপলাইন। কোথাও ছিদ্র থাকলে ময়লা ঢুকতে পারে। খাওয়ার জন্য টিউবওয়েলের পানি অথবা পাইপলাইনের পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়াসহ অন্যান্য পৌরসভা থেকে আরও বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।