ডলার-সংকটের জের, টানা ৫ দিন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ
কয়লাসংকটে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাগেরহাটের রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন এখনো শুরু করা যায়নি। গত শনিবার থেকে টানা পাঁচ দিন কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ আছে। ডলার–সংকটের কারণে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খুলতে না পারায় কয়লার আমদানি বন্ধ আছে। এর জেরে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর মাত্র ২৭ দিনের মাথায় গত শনিবার সকালে কয়লা না থাকায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার প্রথম ইউনিটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বিনিয়োগে রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষম কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট আছে। এর মধ্যে ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট দিয়ে গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুতের সরবরাহ শুরু হয়। নিয়মিত ৫৬০ থেকে ৫৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছিল কেন্দ্রটি। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার কথা।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নামে বহুল পরিচিত বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আনোয়ারুল আজীম গত রোববার ‘কয়লা না থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ’ রাখার কথা জানিয়েছিলেন। তবে কেন্দ্রটি চালু করা সম্ভব হয়েছে কি না, সেটা জানতে কয়েকবার তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
বিআইএফপিসিএল সূত্র বলছে, ডলার–সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়লা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমোদন দিচ্ছে না। এতে তারা কয়লা আনতে পারছে না। বিষয়টি চিঠি দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) জানানো হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। তবে বিষয়টির সুরাহা হয়নি। শেষ কয়েক দিন জরুরি রিজার্ভের কয়লা দিয়ে উৎপাদন চালু রাখা হয়েছিল। তা-ও শেষ হওয়ায় গত শনিবার বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার মজুত সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়। এ জন্য বাধ্য হয়ে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ আছে। নতুন করে কয়লা না আসা (আমদানি) পর্যন্ত উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে কয়লার আমদানির বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি।
কয়লা আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এলসি খোলার অনুমতি পাওয়া গেছে কি না বা কেন্দ্রটি চালুর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে কি না, জানতে বিদ্যুৎকেন্দ্রর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউই কথা বলতে রাজি হননি। ‘এ বিষয়ে আমি দায়িত্বশীল নই, কিছু বলতে পারব না’ বলে সবাই এড়িয়ে যান।
অবশ্য গত রোববার বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজিএম আনোয়ারুল আজীম বলেছিলেন, ‘আমরা টাকা দিতে (পেমেন্ট) পারছি না, এ জন্য আমরা কয়লা পাচ্ছি না। কয়লা না থাকায় কেন্দ্রটি এখন বন্ধ আছে। আমাদের কয়লা ছিল। এটা দিয়েই চলছিলাম। ধারণা ছিল, এর মধ্যে পরবর্তী শিপমেন্ট এলে সমস্যায় পড়ব না। এ জন্য পেমেন্টের বিষয়ে আমরা কয়েক দফা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথাও বলেছি। এখনো যোগাযোগ করছি। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক পেমেন্ট করতে পারছে না।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। বাকি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো খুলনায়। নিয়মিত উৎপাদনের জন্য কেন্দ্রটিতে প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিকটন কয়লা লাগত। এ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আসত ইন্দোনেশিয়া থেকে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, রামপালের বিদ্যুৎ পিডিবিকে কিনতে হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ থাকলেও পিডিবিকে কেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যয় বা ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) দিতে হবে।
সুন্দরবনের কাছাকাছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান হওয়ায় এর পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে শঙ্কা রয়েছে পরিবেশকর্মীসহ সচেতন মহলে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলার আহ্বায়ক মো. নূর আলম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে সরকারকে এ প্রকল্প থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছিলাম। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি একদিকে যেমন সুন্দরবন ধ্বংসকারী, প্রাণ-প্রকৃতির জন্য হুমকি; অন্যদিকে আর্থিকভাবেও ক্ষতিকর। সারা বিশ্ব যখন কয়লার মতো জ্বালানি থেকে সরে আসছে, সরকার তখন এ প্রকল্প গ্রহণ করে। এর চেয়ে সস্তায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তাই সরকারের সেদিকে মনোযোগী হওয়া দরকার।’