বরেন্দ্রর উঁচু ভূমিতে লংগান চাষের অপার সম্ভাবনা
নওগাঁর সাপাহার উপজেলার তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা। সাপাহারের গোডাউনপাড়া ও পত্নীতলা উপজেলার রূপগ্রাম এলাকায় ১৫০ বিঘা জমিজুড়ে গড়ে তোলা তাঁর দুটি মিশ্র ফলবাগান এলাকায় ইতিমধ্যে সাড়া ফেলেছে। বাগানে দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির ফল চাষ করে বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছেন তিনি।
চাকরি ছেড়ে কৃষিতে ঝুঁকে পড়া সোহেল এবার তাঁর সমন্বিত কৃষি খামারে বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি কৃষি প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে নতুন ধরনের ফল চাষ করেছেন। ফলটি লিচু থেকে কিছুটা ছোট, তুলনামূলক শক্ত বাদামি খোসা। কিন্তু ভেতরটা লিচুর মতোই, স্বাদও একই। এর নাম লংগান। খোসা ছাড়ালে চোখের মতো দেখতে, তাই চীনে লংগানকে ‘ড্রাগনস আই’ বলা হয়। থাই জাতের এই লংগান সুমিষ্ট ও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হওয়ায় আশপাশের চাষিরাও এ জাতের লংগান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বরেন্দ্র এলাকায় উচ্চ মূল্যের অপ্রচলিত এই ফল চাষে বাণিজ্যিক চাষাবাদের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন কৃষিবিদেরা।
সম্প্রতি সাপাহার উপজেলার গোডাউনপাড়া এলাকায় সোহেল রানার বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্ক নামের মিশ্র ফলবাগানে গিয়ে দেখা যায়, ১৩৫ বিঘা জমিজুড়ে গড়ে তোলা মিশ্র ফলবাগানের একটি অংশে লংগান গাছ লাগানো রয়েছে। সেখানে লাগানো ৫০টি গাছের সব কটিতেই থরে থরে ফল ধরেছে। মার্বেল আকৃতির ছোট ফলগুলো হয়ে উঠেছে পরিপক্ব। আকারে লিচুর সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও স্বাদে বেশ মিল রয়েছে।
বিএমডিএ বাস্তবায়িত ‘বরেন্দ্র এলাকায় উচ্চ মূল্যের অপ্রচলিত ফল ও ঔষধি ফসল চাষাবাদ জনপ্রিয়করণ প্রকল্প’–এর একটি কৃষি প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে সোহেল রানা তাঁর মিশ্র ফলবাগানে তিন বিঘা জমিজুড়ে ৫০টি লংগান চারা রোপণ করেন। চারা লাগানোর দেড় বছরের মাথায় তাঁর লাগানো গাছগুলোতে ফল পাচ্ছে। আড়াই থেকে তিন ফুট উচ্চতার প্রতিটি গাছে শোভা পাচ্ছে বাদামি রঙের লংগান ফল।
থাই লংগান চাষের পর আশপাশের কৃষি উদ্যোক্তারা লংগান ফল দেখতে তাঁর বাগানে ভিড় করছেন বলে জানান সোহেল রানা। তিনি বলেন, অনেক চাষি তাঁর বাগান পরিদর্শন করছেন। তাঁরা চারা কেনার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাঁর কাছ থেকে জেনে নিচ্ছেন থাই লংগান চাষের কৌশল। এই মৌসুমে গাছ থেকে ফল ওঠানোর পর গুটি কলম করে চারা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। চারা বিক্রির পাশাপাশি আরও ২০০ নতুন চারা লাগানোর ইচ্ছা আছে তাঁর।
লংগানের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সম্পর্কে কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা বলেন, বর্তমানে বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশে আনা এই ফল ঢাকার বিভিন্ন সুপারশপ ও বড় ফলের দোকানে ৭০০-৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বাজারে লিচু শেষ হয়ে যাওয়ার এক মাস পর, অর্থাৎ জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে লংগান পাকতে শুরু করে। থাকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এই ফল চাষে লাভবান হওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বরেন্দ্র এলাকায় উচ্চ মূল্যের অপ্রচলিত ফল ও ঔষধি ফসল চাষাবাদ জনপ্রিয়করণ প্রকল্প’-এর পরিচালক সেলিম কবীর বলেন, লংগান লিচুর মতোই এটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও একই পরিবারভুক্ত ফল। লিচুর মৌসুম শেষ হওয়ার কিছুদিন পর লংগান ফল পাওয়া যায়। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরেও জীবন ধারণ করতে পারে। লংগান চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি জমি উপযুক্ত। এ জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিএমডিএ বাস্তবায়িত বরেন্দ্র এলাকায় উচ্চ মূল্যের অপ্রচলিত ফল ও ঔষধি ফসল চাষাবাদ জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের মাধ্যমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ১৩টি উপজেলায় বিভিন্ন উচ্চ মূল্যের ফলের পাশাপাশি এই লংগান ফল চাষাবাদের জন্য কৃষকদের বিনা মূল্যে চারাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে সাপাহারে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানে লংগান ফলের প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে।
লংগানের পুষ্টিগুণ
বিভিন্ন ধরনের খনিজ উপাদান, শর্করা ও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায় এই ফলে। লংগান ফলের বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে, যেমন অনিদ্রা দূর করতে বিশেষ প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়। এ ছাড়া এর পাতা এলার্জি, ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করা যায়।
চাষের পদ্ধতি
বীজ থেকে সহজেই লংগানের চারা তৈরি করা গেলেও গুটি কলম ও ক্লেফ গ্রাফটিং হচ্ছে অঙ্গজ বংশবিস্তারের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত পদ্ধতি। মে-জুন মাসে কাঙ্ক্ষিত মাতৃগাছ থেকে চার-পাঁচ মাস বয়স্ক সায়ন সংগ্রহ করে ফাটল পদ্ধতিতে জোড়া লাগানো হলে কলমের বৃদ্ধি ভালো হয়। এ পদ্ধতিতে উৎপন্ন কলম থেকে দেড়–দুই বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়।
লংগান চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি উত্তম। জমি নির্বাচন করে চাষ ও মই দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। চারা রোপণের ১৫-২০ দিন আগে ৫ মিটার দূরত্বে গর্ত করে মাটির সঙ্গে পরিমাণমতো জৈব ও রাসায়নিক সার ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে রাখতে হবে। এভাবে রাখার ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে চারা রোপণ করতে হবে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় এবং ভাদ্র-আশ্বিন মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে পানি সেচের সুব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই লংগানের চারা-কলম রোপণ করা যায়। প্রতি হেক্টরে ৪৫০-৫০০টি চারা রোপণ করা যায়।