রাজশাহী চিনিকলের সিবিএর এক নেতাকে মারধর করার বিষয়ে ওই চিনিকলের প্রকৌশলী সামিউল ইসলামের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। শুক্রবার চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিঠি দিয়ে তাঁর কাছে কৈফিয়ত তলব করেন।
একই সঙ্গে ওই প্রকৌশলীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনায় চিনিকলের তিন কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া এই ঘটনায় চিনিকল সিবিএ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে।
প্রকৌশলী সামিউল ইসলাম রাজশাহী চিনিকলে সহকারী ব্যবস্থাপক (সিভিল) পদে কর্মরত। আর সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া তিন কর্মচারী হলেন টারবাইন অপারেটর সোহেল রানা, খালাসি আলমগীর হোসেন ও হিসাব শাখার অফিস সহায়ক মুরাদুল ইসলাম।
২৪ মার্চ রাজশাহী চিনিকল সিবিএর সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামকে মারধরের ঘটনায় চিনিকল কর্তৃপক্ষ চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে দেয়। বৃহস্পতিবার ওই কমিটি তদন্ত শেষ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল বাশারের কাছে প্রতিবেদন দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সামিউল ইসলামের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়।
এ ছাড়া সিবিএ সভাপতি মাসুদ রানা ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলামের কাছেও কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। তাঁদের সাত দিনের মধ্যে লিখিতভাবে জবাব দিতে বলা হয়েছে।
সহকারী ব্যবস্থাপক (সিভিল) সামিউল ইসলামের কৈফিয়ত তলবের চিঠিতে বলা হয়েছে, চিনিকলের টারবাইন অপারেটর সোহেল রানার কোয়ার্টারে পানির সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলে সামিউল ইসলাম সিবিএর সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তিনি শ্রমিকনেতাকে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেন এবং শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেন। কাজের অগ্রগতির বিষয়টি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে না দিয়ে তিনি অপেশাদার আচরণ করেছেন। বিষয়টি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
শ্রমিকেরা জানান, সবার সঙ্গে এমন আচরণই করে থাকেন সামিউল ইসলাম। বিভিন্ন সময় তিনি শ্রমিকদের সঙ্গেও মারমুখী আচরণ করেন। মাস ছয়েক আগে চিনিকলের যান্ত্রিক প্রকৌশল শাখার প্রধান মেসবাউল ইসলামের সঙ্গেও মারমুখী আচরণ করেন তিনি। সেদিন চিনিকলে নতুনের জায়গায় পুরাতন বোরিং পাম্প ও পাইপ বসাচ্ছিলেন প্রকৌশলী সামিউল। মেসবাউল ইসলাম এই অনিয়মের প্রতিবাদ করলে সামিউল তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন।
চিনিকল সিবিএর সভাপতি মাসুদ রানা বলেন, ‘সংস্কার খাতে প্রতি অর্থবছরে চিনিকলে প্রায় ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। এগুলোর বেশির ভাগ অর্থই ভুয়া ভাউচারে নয়ছয় করেন প্রকৌশলী সামিউল ইসলাম। তিনি চিনিকলের এমডিকেও তছরুপ করা অর্থের ভাগ দেন। এ জন্য এমডি সামিউলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না। রফিকুলকে মারধরের ঘটনায় এমডি শ্রমিক প্রতিনিধি ছাড়াই নিজেদের কর্মকর্তাদের নিয়ে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করেন। নিজেদের মতো করে তদন্ত প্রতিবেদন করে সামিউলকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। উল্টো “শায়েস্তা” করতে তিন কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং আমি এবং আমার সাধারণ সম্পাদক রফিকুলকে কৈফিয়ত তলবের চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
সিবিএ সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাকে রড দিয়ে মেরে আঙুল কেটে দিয়েছেন সামিউল। এ ঘটনায় এমডির কাছে সংগঠনের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ করেছি। কিন্তু এ অভিযোগের তদন্ত হয়নি। সামিউল উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন। সেই অভিযোগ তদন্ত করে তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এমন পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের কারণে চিনিকলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’
সিবিএ নেতার ওপর হামলা, শ্রমিকদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ এবং চিনিকলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী সামিউল ইসলাম শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কৈফিয়ত তলবের চিঠি পেয়েছেন। পরে জবাব দেবেন। অধীনদের সঙ্গে মারমুখী আচরণের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি বলেন, এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। একটা ঘটনা ঘটলে তার সূত্র ধরে মানুষ নানা কথা বলে। এগুলোও তা-ই। তিনি বলেন, তিনি শ্রমিকনেতাকে রড দিয়ে মারেননি। রড দিয়ে মারলে কি শুধু চামড়া কেটে যায়? হাতই ভেঙে যাবে। ওরা তাকেই মেরেছে। তারা তার টেবিল ফ্যান ভেঙে দিয়েছেন। শ্রমিকনেতারাই তার সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
জানতে চাইলে চিনিকলের এমডি আবুল বাশার বলেন, ‘রফিকুল সিবিএ নেতা পরে, আগে আমার কর্মচারী। তিনি তাঁর বিভাগের (কারখানা) মাধ্যমে অভিযোগ না করে সংগঠনের পক্ষ থেকে করেছেন। এ জন্য তাঁর অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, সামিউলের বদলির জন্য মৌখিকভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম। কিন্তু বদলি করা হয়নি। এর মধ্যে এবার শ্রমিকনেতার সঙ্গে ‘অপ্রীতিকর’ ঘটনা ঘটল।’ সংস্কারকাজে অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সব কাজ স্বচ্ছভাবেই হয়।’
২৪ মার্চ শ্রমিকনেতা রফিকুল ইসলামকে মারধরের ঘটনায় তিনি রাজশাহীর কাটাখালী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে ঘটনাটি সরকারি প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিযোগের তদন্ত করছে না পুলিশ। তবে ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিদর্শন ও তদন্ত) আকুল হোসেনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছেন। কমিটির দুই সদস্য হলেন ব্যবস্থাপক (সংস্থাপন) সাইফুল ইসলাম ও উপব্যবস্থাপক (পুরকৌশল) শাহিনুল ইসলাম। শুক্রবার ওই তদন্ত কমিটির সদস্যরা চিনিকলেই অবস্থান করছিলেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান আকুল হোসেন বলেন, ‘আমাদের তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও সময় নেব। সঠিক বিষয়টা আমরা তুলে আনতে চাই। তারপর আমরা করপোরেশনে প্রতিবেদন দেব। সে অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।’