বিআরটি প্রকল্পে কাজ বাকি রেখে চালু হচ্ছে বাস, সুফল নিয়ে শঙ্কা

  • বিআরটি প্রকল্পের লেন শুধু বিআরটিসি বাসের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পর মহাসড়কে যানজট বাড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন।

  • পথচারীদের হাঁটার ফুটপাত সংকুচিত হওয়ায় তাঁরা সড়কে চলতে বাধ্য হবেন। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকছে।

বিআরটি প্রকল্পে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর এলাকায় পদচারী–সেতু ও বাস স্টপেজের নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। সোমবার দুপুরেছবি: দীপু মালাকার

সড়ক বিভাজক, স্টেশন, পদচারী–সেতু নির্মাণসহ বেশ কিছু কাজ বাকি রেখেই বহুল আলোচিত বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে বাস চলাচল শুরু হচ্ছে। প্রকল্প শুরুর প্রায় এক যুগ পর আসন্ন বিজয় দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে গাজীপুর থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি লেনে বাস চলাচল উদ্বোধনের ঘোষণা দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এমন অবস্থায় যাত্রীদের মধ্যে প্রকল্পের সুফল পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে দুটি এসি বাস দিয়ে গাজীপুরের শিববাড়ী থেকে বিআরটি লেন দিয়ে আবদুল্লাহপুর হয়ে ঢাকার গুলিস্তান পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে কাজ শেষ না হওয়ায় পরীক্ষামূলক বাসে চলাচলকারী যাত্রীরা নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রকল্পের পুরোপুরি সুফল পেতে আগামী জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর একনেকে বিআরটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। তিন দফা সংশোধনের পর প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর কাজ শেষের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটিও হয়নি। সর্বশেষ বলা হয়েছিল, চলতি বছরের আগস্টে কাজ শেষ হবে। পরে সরকার আবার ডিসেম্বরে উদ্বোধনের কথা জানায়। এর মধ্যে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে বিআরটি প্রকল্পে ভাঙচুর হয়। ফলে প্রকল্পের উদ্বোধন নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রকল্পের পুরোপুরি সুফল পেতে আগামী জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

গত শনিবার দুপুরে প্রকল্প পরিদর্শন শেষে গাজীপুরের শিববাড়ী বিআরটি স্টেশনে এক সভায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহছানুল হক উদ্বোধনের বিষয়টি জানান। সড়কটি চালু হলেও বেশ কিছু সমস্যা থেকে যাবে, যার সমাধান এক দিনেই হবে না উল্লেখ করে ওই দিন তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৯৮ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ বাস চলাচলের মধ্যেও চলমান থাকবে। আশা করছি, আগামী বছরের জুনে এই প্রকল্প পুরোপুরি ফাংশনাল (কার্যকর) করা সম্ভব হবে।’

আমরা অনেক আশা করে আছি ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা মেট্রোরেলের মতো ভালো একটা কিছু হবে। কিন্তু এক যুগ ধরে আমরা প্রকল্পের কারণে দুর্ভোগের মধ্যেই আছি। এখনো সুফল পাওয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে।
শিক্ষার্থী হাসান আবদুল্লাহ

চলছে শেষ সময়ের কাজ

গত সোমবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত গাজীপুরের শিববাড়ী থেকে উত্তরার আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ঘুরে প্রকল্পের বিভিন্ন পয়েন্টে কাজ চলতে দেখা গেছে। সরেজমিনে আরও দেখা যায়, একটি স্টেশনের কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। অনেক জায়গায় পদচারী–সেতুর কাজও অসমাপ্ত রয়েছে। কোনো স্টেশনে এস্কেলেটর ও লিফট লাগানো হয়নি। সড়কের মাঝখানের বিআরটির জন্য নির্ধারিত লেনটি আলাদা করার জন্য কিছু জায়গায় লোহার রেলিং ব্যবহার করা হলেও বেশির ভাগই শেষ হয়নি। সড়ক বিভাজকের কাজ শেষ না হলে দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ময়মনসিংহ থেকে ঢাকামুখী একটি উড়ালসড়কের কাজও বাকি রয়েছে।

বিআরটি প্রকল্পের শুরুতে বলা হয়েছিল, প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার মানুষ যাতায়াত করতে পারবেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট অনেকটাই কমে যাবে।

গাজীপুরে অবস্থিত ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের শুরু থেকেই তাঁরা বিরোধিতা করে আসছেন। গাজীপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অনেক পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকদের চলাচল করার জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত রাখা হয়নি। এ ছাড়া অনেক সমস্যা রয়েছে। তারপরও এত টাকা খরচ করে কাজটা যেহেতু হয়ে গেছে, তাই এখন তিনি চান অপারেশনটা (পরিচালনা) যাতে ভালো করে করা হয়।

তবে এই প্রকল্পের লেন শুধু বিআরটিসি বাসের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পর মহাসড়কে যানজট বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দা লোকজন। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে অনেক জায়গায় বিআরটি লেন দিয়ে সাধারণ যানবাহনও চলছে। উদ্বোধনের পর বিআরটির বাস নির্ধারিত লেনে নির্বিঘ্নে চললেও পাশের দুই লেনে যানজট বাড়বে।

মহানগরীর বোর্ডবাজার এলাকার বাসিন্দা ও টঙ্গী কলেজের শিক্ষার্থী হাসান আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা অনেক আশা করে আছি ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা মেট্রোরেলের মতো ভালো একটা কিছু হবে। কিন্তু এক যুগ ধরে আমরা প্রকল্পের কারণে দুর্ভোগের মধ্যেই আছি। এখনো সুফল পাওয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে।’

এ বিষয়ে বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প পুরোটা এখন উদ্বোধন হচ্ছে না, বিআরটিসির বাস চলাচলের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সব কটি স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বিদ্যুৎ–সংযোগ, লিফট, এস্কেলেটরসহ ফিনিশিংয়ের কাজ চলমান। এখন বাস চলাচল করবে, পাশাপাশি অন্য কাজগুলোও চলবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে তিনি আশাবাদী।

ঢাকায় যাচ্ছি দোকানের মালামাল কিনতে। শখের বসেই এই বাসে উঠেছি। ১ ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাস ছেড়েছে। এভাবে সার্ভিস দিলে আমাদের মতো মানুষ এই বাসে উঠবে না।
প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক

পরীক্ষামূলক বাসে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা

সোমবার সকাল সাড়ে আটটা। শীতের সকালে বিআরটি শিববাড়ী স্টেশনের কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেল, দুজন যাত্রী বসে আছেন। পাশেই চেয়ার–টেবিলে বসে গল্প করছেন চালক পাপ্পু মিয়া ও কাউন্টারম্যান মো. ইব্রাহিম। কিছু সময় পর আরও কয়েকজন যাত্রী এলে কাউন্টারম্যান হাতে থাকা ছোট ডিভাইস দিয়ে ই-টিকিট (রসিদ) দেওয়া শুরু করেন।

১ ঘণ্টা ১৩ মিনিট অপেক্ষার পর ১৬ জন যাত্রী নিয়ে ৯টা ৪৩ মিনিটে যাত্রা শুরু করে বাস। পথে কোথাও না থামায় ৯ মিনিটে বাস পৌঁছে যায় চান্দনা চৌরাস্তা স্টেশনে। সেখানে আরও তিনজন যাত্রী বাসে ওঠেন। বাসচালক মো. পাপ্পু মিয়া বলেন, প্রচার–প্রচারণা ও বাসের সংখ্যা কম থাকায় যাত্রীরা আসছেন না। যখন বেশি বাস থাকবে এবং নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যাবে, তখন যাত্রীসংখ্যা বেড়ে যাবে।

১০টা ৩ মিনিটে বাস বোর্ডবাজার স্টেশনে পৌঁছায়। ব্যস্ত মহাসড়কে ৫ কিলোমিটার সড়ক যেতে সময় লাগে ১১ মিনিট। আর কোনো যাত্রী না থাকায় বাসটি বিআরটি লেনে যেতে থাকে। তবে ১০টা ৯ মিনিটে টঙ্গীর আউচপাড়া এলাকায় বিআরটি লেন দিয়ে উল্টো পথে যানবাহন প্রবেশ করায় সেখানে কিছু সময় যানজটে আটকা পড়তে হয়। ট্রাফিক পুলিশের সহায়তায় বাসটি আবার ছেড়ে যায়।

টঙ্গীর স্টেশন রোড স্টেশনে একজন যাত্রী নামলেও কোনো যাত্রী ওঠেননি। বিআরটিসির বাসটি ১০টা ২৬ মিনিটে পৌঁছায় উত্তরার আবদুল্লাহপুর। শিববাড়ী থেকে আবদুল্লাহপুর যেতে সময় লাগে ৪৩ মিনিট।

চলন্ত বাসে বসে কথা হয় প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় যাচ্ছি দোকানের মালামাল কিনতে। শখের বসেই এই বাসে উঠেছি। ১ ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাস ছেড়েছে। এভাবে সার্ভিস দিলে আমাদের মতো মানুষ এই বাসে উঠবে না।’

১০টা ৩ মিনিটে বাস বোর্ডবাজার স্টেশনে পৌঁছায়। ব্যস্ত মহাসড়কে ৫ কিলোমিটার সড়ক যেতে সময় লাগে ১১ মিনিট। আর কোনো যাত্রী না থাকায় বাসটি বিআরটি লেনে যেতে থাকে। তবে ১০টা ৯ মিনিটে টঙ্গীর আউচপাড়া এলাকায় বিআরটি লেন দিয়ে উল্টো পথে যানবাহন প্রবেশ করায় সেখানে কিছু সময় যানজটে আটকা পড়তে হয়।

বিআরটিসির ব্যবস্থাপক নূর-ই-আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমরা দুটি বাস দিয়েছি। ১৬ ডিসেম্বর উদ্বোধনের পর সকাল সাড়ে ছয়টা বা সাতটা থেকে শুরু করে আধা ঘণ্টা পরপর শিববাড়ী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত বাস চলাচল করবে।’

গাজীপুরে অবস্থিত ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের শুরু থেকেই তাঁরা বিরোধিতা করে আসছেন। গাজীপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অনেক পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকদের চলাচল করার জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত রাখা হয়নি। এ ছাড়া অনেক সমস্যা রয়েছে। তারপরও এত টাকা খরচ করে কাজটা যেহেতু হয়ে গেছে, তাই এখন তিনি চান অপারেশনটা (পরিচালনা) যাতে ভালো করে করা হয়।