সপ্তাহ দুই আগেও মাথার ওপর একটা নিরাপদ চালা ছিল। মাটির ভিটায় দাঁড়িয়েছিল বাঁশ, বেড়া ও টিনের তৈরি ঘরটি। দিন শেষে ঘরটিতেই মাথা গুঁজে তাঁদের কেটে গেছে। কিন্তু হঠাৎ বদলে গেছে সবকিছু। বন্যার পানিতে ঘরের সঙ্গে ভিটার মাটিও ভেসে গেছে। স্থানটিতে ঘরের চিহ্ন বলতে আর কিছু নেই।
ঘর হারানো এই মানুষের আশ্রয় হয়েছে মনু নদ প্রকল্পের বাঁধের ওপর। বাঁধের ওপর ‘উরা (তাঁবুর মতো ঘর)’ বানিয়ে কোনো রকম দিন কাটছে তাঁদের। কবে ভিটার ওপর একটা ঘর হবে, মাথার ওপর নিজের একটা চালা হবে—এর কিছুই তাঁদের জানা নেই। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের কদমহাটা এলাকায় মনু নদ প্রকল্পের বাঁধের একটি ভাঙনের মুখেই ছিল তাঁদের ঘর।
গতকাল শনিবার বিকেলে কদমহাটা এলাকায় মনু নদ প্রকল্পের বাঁধের ভাঙনের কাছে এই পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়। বাঁধের ভাঙনের মুখে যে ঘর ছিল, তা এখন বোঝার উপায় নেই। পানির স্রোতে ভিটার মাটি ভেসে গিয়ে স্থানটি সমতল হয়ে আছে। পানির স্রোতে মাটি ভেসে যাওয়ার চিহ্ন ছাড়া আর কিছু নেই। কেউ না বললে বোঝা যাবে না, ওখানে একদিন ঘর ছিল। তবে ওই স্থানটির এক পাশে নতুন করে একটি ঘর তৈরি হচ্ছে। ঘরের জন্য বাঁশের কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। কারও আর্থিক অনুদানে একটি পরিবারের মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হচ্ছে। ভিটার মাটি ভেসে গেছে এমন অপর দুটি পরিবারের জানা নেই, কবে তাদের ভিটার ওপর এ রকম একটি ঘরের কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হবে। তাদের নিজেদের সেই সামর্থ্য নেই। তাঁরা এখন মনু নদ প্রকল্পের ওপর তাঁবুর মতো ‘উরা’ বা অস্থায়ী ঘর বানিয়ে আছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই সেই উরায় গোছগাছ করতে, কুপিবাতি জ্বালাতে দেখা গেছে। ভাঙনের স্থানটিতে অন্য একটি কাঁচা ঘর। সেটিও অনেকটা ভাঙাচোরা হয়ে আছে। বন্যার পানিতে বাঁশের বেড়া ভেঙে পড়েছে। ভিটার মাটি এদিক-ওদিক ধসে গেছে। এ রকম ঘরটিতেই পরিবারের লোকজন বসবাস করছেন।
ঘর হারানোদের একজন সালমা বেগম (৩০) গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরার ঘর একবারে ভাঙার মুখে। এত পানি অইব (হবে) বুঝছি না। কোনো রকম ছোট বাইচ্চা লইয়া (নিয়ে) ঘর থাকি বারইছি (বের হয়েছি)। অখন বান্ধর (এখন বাঁধের) ওপর আছি। তেরপল দিয়া উরা বানাইয়া রইছি (বানিয়ে আছি)। থাকা যায় না। কাইল রাইতে (রাতে) বিষ্টি (বৃষ্টি) দিছে। হকলতা (সবকিছু) ভিজি গেছে। আইজ আস্তা দিনে হুকাইছি (আজ সারা দিনে শুকিয়েছি)। নিজে ঘর বানানির তওফিক নাই (নিজে বানানোর সামর্থ্য নেই)। এখন যদি কেউর দয়া অয় (কারও দয়া হয়)। ঘর বানাই (তৈরি করে) দেয়, তাইলে বাইচ্চা-কাইচ্চা লইয়া (নিয়ে) থাকতাম।’
একই রকম ভাঙনের মুখে বন্যায় ঘর হারিয়েছেন সোনিয়া বেগম (২৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্যায় ভিটাটাও লইয়া গেছেগি (নিয়ে চলে গেছে)। কিচ্ছু লইয়া বাইর অইতাম (নিয়ে বের হতে) পারছি না। স্বামীও প্রতিবন্ধী মানুষ। ছোট একটা বাইচ্চা লইয়া বান্ধর ওপর আছি। তেরপল দিয়া উরা বানাইয়া রইরাম (বানিয়ে থাকছি)।’
সালমার মতো সোনিয়ারও ভিটার কোনো অস্তিত্ব নেই। পানির স্রোতে সব ভেসে গেছে। একইভাবে আছমারও ঘর, ঘরের ভিটামাটি পানিতে ভেসে গেছে। তবে আছমার ভিটার ওপর এখন একটি ঘর উঠছে। বাঁশের খুঁটি গেড়ে এরই মধ্যে ঘরের কাঠামো তৈরি হয়ে গেছে। আছমা জানিয়েছেন, সিলেটের কেউ একজন তাঁর এই ঘর করে দিচ্ছেন। ঘরটি ফিরে পাওয়ার আনন্দ তাঁর চোখেমুখে। তবে ঘরটিতে শুধু থাকার ব্যবস্থা হবে। রান্নাঘর ও বারান্দা নেই। রান্নাঘর না থাকায় কী করে রান্নাবান্না করবেন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছেন। তাঁদের ঘরের পাশেই খালেদ মিয়ার ঘর। তাঁর ঘরটা আপাতত খাড়া থাকলেও বেড়া ঝুলে আছে। ভিটার অনেক স্থানের মাটি ভেসে গেছে। এতে যেকোনো সময় ঘরটি ধসে পড়তে পারে। খালেদ মিয়া বলেন, ‘কোনো রকম আছি। ঘর খাড়া আছে খালি (শুধু)।’
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, কদমহাটার এই ভাঙনের আশপাশে ১০ থেকে ১৫টি ঘর আছে। সব কটি ঘরই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে মনু নদের পানি বিপৎসীমা ছাড়িয়ে গেলে রাজনগরের কদমহাটা এলাকায় মনু নদ প্রকল্প বাঁধের একাধিক স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে রাজনগর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আউশ, আমন ফসলসহ বিভিন্ন ধরনের সবজিখেত পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে। অনেকের ঘর পানিতে ভেঙে পড়েছে। অন্যের বা সরকারি সহযোগিতা না পেলে সোনিয়া, সালমাদের পক্ষে ঘর বানানো সহজ হবে না।
রাজনগর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, রাজনগর উপজেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় তিন হাজারের বেশি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০০ ঘর।
রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুপ্রভাত চাকমা আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিও ওই (কদমহাটা) ভাঙনের জায়গাটিতে গিয়েছি। ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক একটা তালিকা করে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলে অনুসন্ধান করে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের জন্য অনুদান দেওয়া হবে।’