লিভার সিরোসিসে মায়ের মৃত্যু, একই রোগে ধুঁকে ধুঁকে জ্বলছে হৃদয়ের জীবনপ্রদীপ
নড়াইল পৌরসভার ডুমুরতলা গ্রামের তরুণ হৃদয় খান (২৩)। ২০১৮ সালে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মা আলেকা বেগমের মৃত্যু হয়। বছরখানেক পরে একই রোগ ধরা পড়ে হৃদয়ের শরীরে। এতে দিশাহারা হয়ে পড়ে তাঁর বাবা ইমারত খান। সহায়–সম্বল যা ছিল, স্ত্রীর চিকিৎসায় ব্যয় করেছেন। ছেলের চিকিৎসার জন্য তেমন কোনো অর্থই আর অবশিষ্ট ছিল না। ফলে অর্থাভাবে কিছুদিনের মধ্যে হৃদয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে পাঁচ বছর ধরে দেশ-বিদেশের মানুষের সহযোগিতায় তাঁর চিকিৎসা চলেছে। তবে কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হননি।
এখন অসুস্থতা আরও বেড়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বেঁচে থাকতে হলে দ্রুত হৃদয়ের লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। এ জন্য দরকার প্রায় অর্ধকোটি টাকা। এই টাকার জোগান কী করে হবে, কোথায় গেলে সাহায্য মিলবে, সেসব ভেবে দিন পার করছে দরিদ্র পরিবারটি।
গত রোববার সকালে হৃদয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি একচালা কাঠের ঘরে দুটি কক্ষ। সেখানে বসবাস হৃদয়, তাঁর বাবা ও ছোট ভাইয়ের। হৃদয় যে কক্ষে থাকেন, তার খাটের ওপর বিছানো একটি পাটি, নেই কোনো তোশক। মাথার বালিশের পাশে একগাদা ওষুধ। সে ঘর থেকেই ফাইলপত্রে ভরা চিকিৎসাসংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র খুলে দেখালেন হৃদয়।
হৃদয় প্রথম আলোকে বলেন, রোগ যখন স্বাভাবিক পর্যায়ে ছিল, তখন অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। পরে এলাকার লোকজন জানার পর তাঁরা এবং বন্ধুরা মিলে টাকা তুলে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এর পর থেকে প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা চিকিৎসায় ব্যয় হতে থাকে। মানুষের সহযোগিতায় এই ওষুধের টাকা জোগাড় হতো। নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা।
এর আগে লিভারের সমস্যা নিয়ে মোটামুটি সুস্থ থাকলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে আহত হওয়ার পরই মূলত বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানান হৃদয় খান। তিনি বলেন, আন্দোলনে অংশে নিয়ে বাঁ পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙে যায়। সে অবস্থায় প্রথমে নড়াইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে পায়ে ইনফেকশন থেকে পচন ধরলে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরেন; কিন্তু পায়ের সমস্যা পুরোপুরি ঠিক হয়নি। বরং শরীর আগের চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল হয়েছে। লিভারের সমস্যাও বেড়েছে।
হৃদয় খান বলেন, ‘আমার চিকিৎসকেরা বলেছেন, ইতিমধ্যে লিভার অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই লিভার প্রতিস্থাপনের বিকল্প নেই। একদিকে লিভারসংক্রান্ত সমস্যা বাড়ছে, অন্যদিকে পায়ের সমস্যায় হাঁটতে পারছি না। এখন প্রতিদিন অনেক টাকার ওষুধ লাগে। তা ছাড়া চিকিৎসকেরা যে চিকিৎসার কথা বলেছেন, তা করানোর মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।’
হৃদয়ের অসুস্থতার ব্যাপারে এলাকার প্রায় সবাই জানেন। দরিদ্র পরিবারটির অবস্থা তুলে ধরে ডুমুরতলা এলাকার আবদুর রাজ্জাক ও আরজান বেগ বলেন, ‘ওদের নিজস্ব কোনো জায়গাজমি নেই। যে জায়গায় আছে, সেটাও হৃদয়ের মামার জায়গা। মা অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে হৃদয়ও অসুস্থ। অনেক লোক সাহায্য–সহযোগিতা করেছেন। তাতে ওষুধের কেনার টাকা হয়। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। ভালো কোনো জায়গা থেকে সাহায্য পেলে ছেলেটা সুস্থ হতে পারবে।’
হৃদয়ের বাল্যবন্ধু জুবায়ের মোল্যা বলেন, ‘হৃদয়ের চিকিৎসার জন্য আমরা সমাজের উচ্চবিত্তদের দ্বারে দ্বারে হাত পেতেছি, হাটবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছি। এ ছাড়া আমরা বন্ধুরা নিজেদের হাতখরচ থেকে অর্থ দিয়ে হৃদয়ের চিকিৎসা এবং ওষুধ খরচ প্রদান করে থাকি। হৃদয়ের সম্পূর্ণ সুস্থতার জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। আমরা সমাজের উচ্চবিত্ত ও সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, আমাদের বন্ধুকে বাঁচাতে আপনারা সহযোগিতা করেন।’
হৃদয়ের বাবা ইমারত খান বলেন, ‘আমার যা কিছু ছিল, সবই শেষ হয়ে গেছে ওদের চিকিৎসায়। পরের জায়গায় থাকি। দিনমজুরি করে ছেলেদের মুখে খাবার তুলে দিই। কখনো খাবার জোটে, কখনো জোটে না। চিকিৎসক বলছে, প্রায় ৫০ লাখ টাকা লাগবে চিকিৎসায়। এত টাকা আমি কোথায় পাব?’