আট বছর ধরে আশরাফুলের দোকানে খেতে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর

কবুতরগুলোকে গম খেতে দিচ্ছেন ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলামের দোকানের এক কর্মচারী। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের নতুনবাজার এলাকায়নূরে আলম সিদ্দিকী

আট বছর আগে দোকানের বারান্দায় একটি অচেনা কবুতর এসেছিল। কবুতরটিকে খেতে দেন দোকানি আশরাফুল ইসলাম (৫৫)। পরদিন একই সময়ে দোকানে আসে তিনটি কবুতর। তাদেরও খেতে দেন তিনি। এর পর থেকে দোকানের সামনে বারান্দায় বাড়তে থাকে কবুতরের সংখ্যা। এখন প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টা বাজলেই দুই শতাধিক কবুতর এখানে এসে হাজির হয়। খাবার ছিটিয়ে দিলে তা খেয়ে আবার চলে যায়।

প্রতিদিন এমন দৃশ্য দেখা যায় দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের নতুনবাজার এলাকায় দয়াল ভান্ডার নামের সবজির আড়তে। আড়তের মালিক ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলামের বাড়ি পৌরসভার মাহমুদপুর মহল্লায়। আট বছর ধরে তিনি এসব কবুতরকে প্রতিদিন নিয়ম করে দুপুরের খাবার হিসেবে গম খাওয়ান। কবুতরগুলো কোথা থেকে আসে, তা জানেন না আশরাফুল। তবে কবুতরগুলোকে খাবার দিয়ে তিনি আনন্দ পান। এসব কবুতরকে খাওয়ানোর জন্য প্রতিদিন তাঁকে দেড় থেকে দুই কেজি গম ছিটাতে হয়।

বিদ্যুতের তারে বসে আছে কিছু কবুতর। আর কিছু কবুতর খাবার খাচ্ছে। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের নতুনবাজার এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কবুতরগুলো টিনের চালে ঝাঁকে ঝাঁকে এলে কখনো আশরাফুল নিজে খাবার দেন। কখনো দোকানের কাজে তিনি ব্যস্ত থাকলে দোকানের কর্মচারী খাবার দেন। খাওয়া শেষে কবুতরগুলো চলে যায় যে যার গন্তব্যে। আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘কবুতরগুলোকে এভাবে খাওয়াতে পেরে মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করে, নিজের মধ্যে তৃপ্তি লাগে।’

সিলেটে হজরত শাহজালাল (রঃ)–এর মাজারে ঝাঁকে ঝাঁকে জালালি কবুতর এসে খাবার খায়, উড়ে বেড়ায়। অনেক বছর আগে বিষয়টি দেখে তাঁর কবুতরের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। শুধু কবুতর নয়, সব জীবের প্রতি মানুষের দরদ ও ভালোবাসা দেখানো উচিত বলেও মনে করেন আশরাফুল।

সবজি ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

কবুতর ছাড়াও একই সময়ে দোকানের টিনের চালে খাবারের জন্য আসে অচেনা ২০ থেকে ৩০টি কাক। তাদেরও নিয়ম করে খাবার হিসেবে পাউরুটির টুকরা ছিটিয়ে দেন টিনের চালে। এতেই থেমে থাকেননি আশরাফুল ইসলাম। দিনের বিভিন্ন সময় দোকানে খাবার খেতে মা-ছানাসহ আসে চারটি বিড়াল। পাশের আড়তের সবজি ব্যবসায়ী সাব্বির হোসেন আদর করে পুরুষ বিড়ালটির নাম রেখেছেন ‘সম্রাট’। নাম ধরে ডাকলে বিড়ালটি আশরাফুলের দোকানে ছুটে আসে খাবার খেতে। তাদের খাবার হিসেবে দেন পাশের দোকান থেকে কেনা কেক।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বিপুল কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, জীবে প্রেম তো নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় কাজ। ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম নিঃস্বার্থভাবে এতগুলো পশুপাখিকে প্রতিদিন খাবার দিচ্ছেন, সেটি প্রকৃতির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম প্রেম। পশুপাখি থেকে কেউ কোনো স্বার্থ আশা করেন না। তিনি বলেন, ‘কবুতর তো সুখের পায়রা। কবুতর যেখানে ভালোবাসা পায়, সেখানে যায়। কবুতরগুলো মানুষটির কাছে ভালোবাসা পাচ্ছে। আমি এটিকে অবশ্যই ভালো চোখে দেখছি। এ জন্য মানুষটিকে (আশরাফুলকে) সালাম দেওয়া উচিত।’

খাবার খাচ্ছে আর ওড়াওড়ি করছে কবুতরগুলো
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, আশরাফুল ইসলামের দোকানঘরের টিনের চালের ওপরে জোড়ায় জোড়ায় কবুতর এসে জড়ো হচ্ছে। টিনের চালের ওপরে বিদ্যুতের তারে পূর্ব-পশ্চিম লম্বা সারিতে বসে আছে অনেক কবুতর। বাকবাকুম, বাকবাকুম শব্দে মুখর আশপাশ। আশরাফুলের দোকানের এক কর্মচারী যে–ই না হাতে খাবারের থলে নিয়ে দোকানের বারান্দায় আসেন, তখনই কবুতরগুলো তাঁকে (কর্মচারীকে) ঘিরে ধরে। খাবার ছিটিয়ে দিলে পাল্লাপাল্লি করে তা খেয়ে নেয়। তখন বাজারের অন্য দোকানি, ক্রেতা ও সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হয়ে এমন দৃশ্য উপভোগ করেন।

প্রতিবেশী মিনহাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশরাফুল ভাই এলাকার একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি সারা দিন ব্যবসার কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। একটু গুরুগম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তবে ব্যক্তি হিসেবে ভালো। তাঁর পরিবারে স্ত্রী, এক মেয়ে ও তিন ছেলে আছে। শহরের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।’

খাবার খেতে ব্যস্ত কবুতরগুলো
ছবি: প্রথম আলো

আশরাফুল ইসলাম বলেন, আট বছর আগে তাঁর দোকানে একটি কবুতর এসেছিল। তখন কবুতরটিকে খেতে দিয়েছিলেন তিনি। তারপর পর্যায়ক্রমে কবুতরের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কবুতরগুলোকে প্রতিদিন প্রায় দুই কেজি গম খেতে দেন। কাকের জন্য আলাদা বাজেট। কাকের জন্য ১০ টাকা দামের পাউরুটি ছিঁড়ে ছোট ছোট করে টিনের চালে ছিটিয়ে দেন। বিড়ালগুলোকে দেন কেক। এতে সব মিলে দিনে প্রায় ১০০ থেকে ১২০ টাকা এবং মাসে ৩ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়।

নতুনবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বাবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরে দেখছি, কবুতরগুলো বাইরে থেকে এখানে আসে। প্রতিদিন দুপুরে আশরাফুল কবুতরগুলোকে খাওয়ান। এটি তাঁর একটি অত্যন্ত মহৎ কাজ।’

আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের খাওয়াতে ভালো লাগে, অন্য কিছুই না। যত দিন সুস্থ থাকব, আমার সামর্থ্য থাকবে, আমি তত দিন তাদের খাওয়াব।’