সম্রাটের নির্দেশে বজরায় রাজ্য পরিদর্শনে এসে গড়েন ‘বজরা শাহী মসজিদ’
পৌনে তিন শ বছর আগের কথা। দিল্লির সম্রাট মুহাম্মদ শাহ বজরায় জমিদার আমান উল্যাহকে রাজ্য পরিদর্শনে পাঠান। সম্রাটের নির্দেশ, রাজ্য পরিদর্শনের শেষ সীমানায় দিল্লির শাহী মসজিদের আদলে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে হবে। জমিদার আমান উল্যাহ্ রাজ্য পরিদর্শন শেষে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরায় বসতি স্থাপন করেন এবং সেখানে দিঘি খনন করে দিঘির পশ্চিম পাড়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সেই মসজিদটিই বজরা শাহী মসজিদ নামে খ্যাতি পেয়েছে।
বজরা নোঙর করায় সোনাইমুড়ী উপজেলার ওই এলাকাটির নাম ‘বজরা’ রাখা হয়। বর্তমানে মসজিদটি জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। দূর-দূরান্তের মানুষ মসজিদ দেখতে ভিড় করেন। দিল্লির বিখ্যাত শাহী মসজিদের অনুকরণে করা মুঘল স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদটি সরকারি গেজেটে প্রত্নসম্পদ হিসেবে থাকলেও সরকারিভাবে কোনো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেই। দর্শনার্থীদের অনুদানেই মসজিদের খতিব, মুয়াজ্জিনসহ চারজনের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়।
ইমাম ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ একর জায়গাজুড়ে উঁচু পাড়যুক্ত একটি দিঘি খনন করেন জমিদার আমান উল্যাহ । ওই দিঘির মাটি দিয়ে পশ্চিম পাশে জমিদার বাড়ি করা করা হয়। বর্তমানে সেটি সরকারের ভূমি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জমিদার আমান উল্যাহ্ তাঁর বসতবাড়ির পূর্বপাশে দিল্লির তৎকালীন সম্রাটের নির্দেশে দিল্লির শাহী মসজিদের আদলে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেন। সুদৃশ্য মার্বেল পাথর দিয়ে গম্বুজগুলো সুশোভিত করা হয়।
সরেজমিনে মসজিদের চার পাশ ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থ এবং প্রায় ২০ ফুট উঁচু মসজিদকে মজবুত করার জন্য মাটির ২০ ফুট উঁচু থেকে ভিত তৈরি করা হয়েছে। মসজিদে প্রবেশের জন্য আছে তিনটি ধনুকাকৃতির দরজা। প্রবেশপথের ওপরে কয়েকটি গম্বুজ। কেবলা দেয়ালে তিনটি কারুকার্য খচিত মিনার। শিলালিপি ও দেয়ালে খোদায় করা ফুল, লতাপাতাসহ বাহারি নকশা মসজিদটিকে দিয়েছে অনন্য শৈল্পিক আকর্ষণ।
বেগমগঞ্জের দুর্গাপুর থেকে মসজিদ দেখতে এসেছেন রেজোয়ান হোসেন (৪৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগে সহপাঠীদের সঙ্গে একবার মসজিদটি দেখতে এসেছিলেন। মসজিদের নির্মাণশৈলী দেখে প্রেমে পড়ে যান। সেই থেকে মসজিদের কথা ভুলতে পারেননি। ব্যস্ততার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আবার দেখতে আসতে পারেননি। এবারের রমজানের শুরু থেকেই মনস্থির করেন, একদিন মসজিদটি দেখতে আসবেন। সেই সঙ্গে মসজিদে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন।
রেজোয়ান বলেন, মসজিদে মোগল আমলের স্থাপত্যশৈলী দেখে মনে প্রশান্তি জাগে। মসজিদের দক্ষিণ পাশে বিশাল কবরস্থানে সারি সারি কবর পরকালের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ কারণে প্রতি শুক্রবার জুমার দিনে মসজিদটিতে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষের ঢল নামে।
মসজিদের সপ্তম ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা ইমাম হাছান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, মুঘল সম্রাটের বিশেষ অনুরোধে মক্কা শরিফের মাওলানা শাহ আবু বকর সিদ্দিকী ঐতিহাসিক এ মসজিদের প্রথম ইমাম নিয়োজিত হন। পর্যায়ক্রমে তাঁর ছয় বংশধর ইতিমধ্যে মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদেরই বংশধর হিসেবে তিনি ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
১৯৮৯ সালের ২৯ নভেম্বর সরকারি গেজেটে প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে মসজিদটির নাম ঘোষণা করা হয়। তবে কোনো ধরনের সরকারি অনুদান ছাড়াই মুসল্লিদের দান-অনুদানে মসজিদটি পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বর্ষায় মসজিদের দক্ষিণের গম্বুজ চুঁইয়ে ভেতরে পানি প্রবেশ করে। মুসল্লিদের অজু ও গোসলের জন্য খনন করা বিশাল দিঘিটিও প্রায় ভরাট হয়ে বিলে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, দেশের অন্যতম এ স্থাপত্যটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে জেলার অর্থনীতিতে দারুণ ভূমিকা রাখবে। তাঁদের মতে, বজরা শাহী মসজিদে যাতে নির্বিঘ্নে দর্শনার্থীরা আসতে পারেন, সে জন্য ঢাকা-নোয়াখালী সড়কের পাশ ঘেঁষে যে সড়কটি আছে, সেটি প্রশস্ত করা দরকার। মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগেরও যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া উচিত।