সতর্ক করার পরও মানা হয়নি রথের উচ্চতা, আয়োজকদের দুষছে প্রশাসন

বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহত ব্যক্তিদের বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ রোববার সন্ধ্যায়ছবি: প্রথম আলো

বগুড়া শহরের রাস্তার ওপর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার থাকায় রথের চূড়ার উচ্চতা আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছিল প্রশাসন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, সড়কে বৈদ্যুতিক তারের অবস্থানভেদে রথের চূড়া ওঠানামা করা হবে। কিন্তু তেমনটি না করায় রথের চূড়ার সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ।

আজ রোববার বিকেলে বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি আমতলা মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আয়োজক কমিটির ভুলে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, এটি আয়োজকদের ভুলে নিছক দুর্ঘটনা। তবু দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং বিদ্যুৎ বিভাগ ও পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) পি এম ইমরুল কায়েস। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের লাশ সৎকারের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছরের মতো এবারও শহরের সেউজগাড়ি ইসকন মন্দির থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা বের করা হয়। বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান, জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বিকেল পাঁচটার দিকে রথযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

প্রশাসনের সতর্কতা সত্ত্বেও ২৫ ফুট উচ্চতায় রথের চূড়া ওঠানো হয়। বগুড়া শহরের স্টেশন সড়কের সেউজগাড়ি এলাকায়
ছবি: সোয়েল রানা

রথযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন বগুড়া শহর পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি পরিমল প্রসাদ। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ১৫ হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের অংশগ্রহণে রথযাত্রা পুলিশ লাইনস–সংলগ্ন মন্দিরের উদ্দেশে রওনা করে। ১০ মিনিটের মাথায় রথযাত্রা শহরের সেউজগাড়ি আমতলা মোড়ে পৌঁছালে রথের চূড়ার সঙ্গে রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তার ও রথের চূড়ায় আগুন ধরে যায়। বিদ্যুতায়িত হন রথ ধরে থাকা অর্ধশতাধিক রথযাত্রী। প্রাণ বাঁচাতে হুড়োহুড়ি, ছোটাছুটিতে পদদলিত হয়ে আহত হয়েছেন অনেকেই।

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বছরে দুই দফা রথযাত্রা ও উল্টোরথযাত্রা বের হয়। শহরের রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের অবস্থান অনুযায়ী ঠিক কত ফুট উচ্চতায় রথ ওঠানো যাবে, তা আয়োজকদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের সেই সতর্কতা সত্ত্বেও ২৫ ফুট উচ্চতায় রথের চূড়া ওঠানো হয়। রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর দায়িত্ব ছিল একজনের হাতে। কিন্তু তাঁর ভুলেই ঘটে গেল মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা।

বগুড়ার সিলিমপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মিলাদুন্নবী প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে চারজনের মৃতদেহ রাখা আছে। তাঁরা বগুড়া সদরের ছোট বেলঘড়িয়া এলাকার নরেন্দ্র নাথ সরকারের ছেলে অলোক কুমার সরকার (৪০), বগুড়া শহরের পুরান বগুড়া হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা ননী কিশোর সরকারের স্ত্রী আতশি রানী (৪৫), আদমদীঘি উপজেলার কুন্দগ্রামের ভবানী মহন্তের ছেলে নরেশ মোহন্ত (৬০), বগুড়া সদরের রঞ্জিতা মহন্ত (৫৫)।

অন্যদিকে স্টেডিয়াম ফাঁড়ির পরিদর্শক আশিক ইকবাল বলেন, মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে একজনের মৃতদেহ আছে। তিনি সারিয়াকান্দি উপজেলার সাহাপাড়ার বাসুদেব সাহার স্ত্রী জলি রানী সাহা (৪০)।

বিভিন্ন এলাকার সনাতন ধর্মালম্বীরা রথযাত্রায় অংশ নেন
ছবি: প্রথম আলো

রথযাত্রা উৎসব আয়োজক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (অধ্যক্ষ) খরাজিতা কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, বহুকাল থেকে বগুড়া শহরে রথযাত্রা ও উল্টোরথযাত্রা উৎসব হয়ে আসছে। অতীতে কখনো এ রকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, রথযাত্রার সবকিছু দেখভাল করতে কমিটির পক্ষ থেকে ১০০ জন সেবক নিয়োগ ছিল। সড়কের ওপর বৈদ্যুতিক তারে যাতে রথের স্পর্শ না লাগে, এ জন্য রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর জন্য দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া ছিল। আমতলা মোড়ে ভুলক্রমে রথের চূড়া নিচে নামানোর আগেই বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লেগে আগুন ধরে যায়। রথে হাত রাখা সবাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। তিনি জানান, চূড়া ওঠানো-নামানোর দায়িত্বে থাকা অলোক কুমার ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। সুশান্ত দাসের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

দুর্ঘটনায় আহত ৩৮ জনকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, এখানে ভর্তি হওয়া ৩৮ জনের মধ্যে আশঙ্কাজনক দুজনকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে। অন্যরা এখনো ঝুঁকিমুক্ত নন।

মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শফিক আমিন কাজল বলেন, এ হাসপাতালে বিদ্যুতায়িত পাঁচজন ভর্তি হন। এর মধ্যে জলি রানী সাহাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।