‘এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম’—আদরের দুই ‘রাজকন্যাকে’ বুকে জড়িয়ে এমন অনুভূতি এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খানের। জাহাজ থেকে নেমেই বুকে টেনে নেন দুই শিশুসন্তানকে। আদর-ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখেন অনেকক্ষণ। বাবাকে কাছে পাওয়ার স্বস্তি রূপ নেয় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। দুই মেয়ের উচ্ছ্বাসে যেন খুশির বাঁধ ভেঙেছে। পিতার দুই গালে ভালোবাসার চুমুতে ভরিয়ে দেয় তারা।
এমন আনন্দময় ছবি দেখা যায় আজ মঙ্গলবার বেলা চারটায় চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের জেটি চত্বরে। ওই সময় জেটিতে ভেড়ে সোমালিয়ার জলদস্যুদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত নাবিকদের বহনকারী জাহাজ। এরপর সেখানে রচিত হয় স্বজনকে কাছে পাওয়ার এই রকম খণ্ড খণ্ড খুশির দৃশ্য।
সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাস পর চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ফিরেছেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকেরা। তাঁরা এমভি জাহান মণি-৩ লাইটার জাহাজে করে এসেছেন। এর আগে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ থেকে নেমে তাঁরা এমভি জাহান মণি-৩ লাইটার জাহাজে ওঠেন।
আতিক উল্লাহ খান সোমালিয়া জলদস্যুদের কাছে জিম্মি হওয়া বাংলাদেশি জাহাজ এম ভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা। দস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর এমন দিন আর ফিরে পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল আতিকের। দুশ্চিন্তায় ছিল পরিবারও। তবে এসব উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটেছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রিয়জনদের কাছে ফিরেছেন আতিক উল্লাহ খান। বাবাকে ফিরে পেয়েছে দুই মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমা ও উনাইজা মেহবিন।
বাবার আসার দিনক্ষণ আগে থেকেই জানা ছিল। তাই স্বজনদের সঙ্গে জেটি চত্বরে চলে আসে ইয়াশরা ও উনাইজা। জীবনের রঙিন দিনটিকে স্মরণীয় করতে রঙিন ফুল নিয়ে এসেছিল তারা। তা দিয়ে বাবাকে বরণ করে নেয় দুই কন্যা। জাহাজ থেকে নামতেই দুই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেন আতিক উল্লাহ খান। আর বাবার গালে-মুখে আদরের চিহ্ন এঁকে দেন চুমুর মাধ্যমে। এমন দৃশ্যে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন উপস্থিত অনেকেই।
এই আনন্দ প্রকাশের ভাষা যেন ছিল না আতিক উল্লাহ খানের। শুধু বললেন, ‘এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম।’
আতিক উল্লাহ খানের দুই শিশুসন্তানের মতো উচ্ছ্বাস ছিল জ্যোৎস্না বেগমেরও। ছেলে তানভীর আহমেদ জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী। জিম্মি হওয়ার চিন্তায় চিন্তায় অস্থির ও অসুস্থ হওয়ার অবস্থা। এখন ছেলেকে পাওয়ার পর এই মায়ের খুশি আর দেখে কে! মায়ের বুকে ফিরতে পেরে ছেলে তানভীরও ছিল খুবই উচ্ছ্বসিত।
ছেলেকে বহনকারী জাহাজ জেটিতে পৌঁছার আগে জ্যোৎস্না বেগম বলেন, ‘ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে। জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ৩৩ দিন যে কীভাবে কেটেছে, তা ব্যাখ্যা করতে পারব না। এখন ছেলেকে কাছে পাব, এর চেয়ে আর বড় সুখ কী হতে পারে।’
গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে কেএসআরএম গ্রুপের এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। জলদস্যুদের হাতে জিম্মির খবরে জাহাজের নাবিকদের পরিবারে নেমে আসে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে জাহাজটি মুক্ত করা হয়। এরপর জাহাজটি প্রথমে আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পণ্য খালাস শেষে আরেকটি বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছিল জাহাজটি। ১৩ দিনের মাথায় জাহাজটি বাংলাদেশের জলসীমায় এসে পৌঁছাল। আরব আমিরাত থেকে রওনা হওয়ার ১৪ দিন এবং জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার এক মাসের মাথায় ঘরে ফিরলেন নাবিকেরা।