ঠাকুরগাঁও
সার নিয়ে সংকটে কৃষক
জমি তৈরির এই সময়ে মূলত অ-ইউরিয়া সারের ব্যবহার করা হয়। সবজি, আম, লিচু, মাল্টাসহ ফলের বাগানে এখন এমওপি সার ব্যবহারের উপযুক্ত সময়।
মাসখানেক আগে শীতের আগাম ফুলকপির চারা তৈরি করে রেখেছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা গ্রামের কৃষক দীপেন রায়। এখন সেসব চারা জমিতে রোপণ করার সময় এসেছে। কিন্তু এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সারের অভাবে সেই কাজটি করতে পারছেন না তিনি। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এ কৃষক।
দীপেন রায় বলেন, ফুলকপির চারা লাগানোর আগেই জমিতে এমওপি সার দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও সার পাচ্ছেন না। দুই-চার দিনের মধ্যে সার না দিতে পারলে ফুলকপির চারাগুলো কোনো কাজে আসবে না। তাঁর মতো বেশির ভাগ কৃষকই এখন সার পাচ্ছেন না।
কৃষি বিভাগ বলছে, এখন আগাম রবি সবজির চারা রোপণের সময়। জমি তৈরির এই সময় মূলত অ-ইউরিয়া সারের ব্যবহার করা হয়। আবার যেসব কৃষক একটু দেরিতে আমন ধান রোপণ করেছেন, তাঁদের খেতে উপরি প্রয়োগের জন্য অ-ইউরিয়া সার প্রয়োজন। তা ছাড়া আম, লিচু, মাল্টাসহ বিভিন্ন ফলের বাগানেও এখন অ-ইউরিয়া সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময়। অ-ইউরিয়া সারের মধ্যে একটি হচ্ছে এমওপি।
*প্রতি বস্তা সারের দাম নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। * বিসিআইসির পরিবেশকদের ৮৫৭ মেট্রিক টন এমওপি সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সাধারণত অ-ইউরিয়া সার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) আমদানি করে। তবে আগস্ট মাসের এমওপি সারের অতিরিক্ত বরাদ্দ ও সেপ্টেম্বর মাসের নিয়মিত বরাদ্দ বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) পরিবেশকদের দেওয়া হয়েছে।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লাহিড়ী এলাকার কৃষক খশিয়র রহমান বলেন, সবজি আর আলুর জমিতে যখন সার প্রয়োগের সময়, তখন ডিলারদের কাছে সার পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু খুচরা সার ব্যবসায়ীদের দোকানে ঠিকই সার পাওয়া যাচ্ছে। কৃষক পর্যায়ে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা এমওপি সারের সরকার নির্ধারিত মূল্য ৭৫০ টাকা হলেও দাম নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় বিসিআইসির পরিবেশক আছেন ৬৩ জন। গত আগস্টে তাঁদের মধ্যে এক হাজার মেট্রিক টন এমওপি সার বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা নিজ খরচে যশোরের নওয়াপাড়া থেকে সংগ্রহ করতে বলা হয়। সেসব সারের মধ্যে ২২ জন পরিবেশক ৩৫৮ মেট্রিক টন সার উত্তোলন করেছেন। আর চলতি সেপ্টেম্বর মাসের জন্য বিসিআইসির পরিবেশকদের ৮৫৭ মেট্রিক টন এমওপি সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেয়ে গতকাল সোমবার দুপুর পর্যন্ত ৫৭ জন পরিবেশক টাকা জমা দিয়েছেন। তবে গতকাল সকাল পর্যন্ত কোনো পরিবেশকই সেপ্টেম্বরের বরাদ্দের সার হাতে পাননি।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বিসিআইসির পরিবেশক নিউ ঐশী বীজ ভান্ডারের কার্যক্রম পরিচালনা করেন এনামুল হক। তিনি বলেন, যাঁরা আগস্টের শেষ দিকেও টাকা জমা দিয়েছেন, তাঁরা এখনো অতিরিক্ত বরাদ্দের এমওপি সার পাননি। তা ছাড়া নওয়াপাড়া থেকে সার উত্তোলন করতে গিয়ে পরিবহন বাবদ তাঁদের প্রতি বস্তায় ৭০–৮০ টাকা খরচই পড়ে যায়। এ ছাড়া লোড–আনলোড করতেও খরচ হয়। আর প্রতি বস্তায় তাঁরা কমিশন পান ১০০ টাকা। খরচের পর এতে হাতে কিছুই থাকছে না।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে বালিয়াডাঙ্গীর লাহিড়ীহাটে শাহ আলম ট্রেডার্সের বিক্রয়কেন্দ্রে কৃষক পর্যায়ে সার বিক্রি করা হচ্ছিল। সে সময় এক কৃষক অতিরিক্ত ১০ বস্তা এমওপি সার দাবি করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আতাউর রহমান তাঁকে সেই সার দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই কৃষক তাঁকে লাঞ্ছিত করেন। আতাউর রহমান এখন বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।
হরিপুর উপজেলার কৃষক বেলাল হোসেনের চার একর জমিতে মাল্টাবাগান আছে। তিনি বলেন, দুজন ডিলারের বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে তিনি এমওপি সার পাননি।
বালিয়াডাঙ্গীর পাঁচ শতাধিক কৃষক আগাম আলু চাষ করেন। এবারও তাঁরা আবাদের জন্য তৈরি। কিন্তু জমি তৈরির জন্য সার পাচ্ছেন না তাঁরা। ঠাকুরগাঁও সদর, রানীশংকৈল ও হরিপুর উপজেলায় ফুলকপি, আলুসহ আগাম সবজি এবং ফলবাগানের জন্য অনেক চাষি এমওপি সার পাচ্ছেন না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুল আজিজ বলেন, সারের সংকট নেই। তবে কৃষকদের মধ্যে একটা শঙ্কা কাজ করছে। এ শঙ্কা থেকেই অনেক কৃষক আগাম সার সংগ্রহে রাখছেন। কোনো কৃষক যাতে চাহিদার বেশি সার নিতে না পারেন, তা নজরে রাখা হচ্ছে। জেলায় অতিরিক্ত এক হাজার টন সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বালিয়াডাঙ্গীর স্কুলের হাট, মহাজনহাট, সদরের রুহিয়া, ঢোলারহাট, পাটিয়াডাঙ্গী, সালন্দরসহ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সার পরিবেশকদের কাছে এমওপি সার না পাওয়া গেলেও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ঠিকই মজুত আছে। আমদানিকারক, পরিবেশক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে তবেই সার যাচ্ছে কৃষকের কাছে।
বিসিআইসির পরিবেশকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) ঠাকুরগাঁওয়ের সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুজ্জামান বলেন, বরাদ্দ পেয়ে অধিকাংশ পরিবেশকই সার উত্তোলনে টাকা জমা করেছেন। তবে সেই সার দূর থেকে আনতে হচ্ছে। সেখানে সিরিয়াল পেতেও দেরি হচ্ছে। তাই পরিবেশকদের সবাই সার আনতে পারেননি। কয়েক দিনের মধ্যে সব ডিলারের কাছেই এমওপি সার পাওয়া যাবে।