‘সাঁতার জানে না ছেলে, কাপ্তাই যাচ্ছে আমাকে বলেনি’
‘আমার ছেলে সাঁতার জানে না। সে জন্য কাপ্তাই যাওয়ার কথা আমার কাছে গোপন করেছে। ডিসি পার্ক যাবে বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে।’ বলতে বলতে তাপসী দে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
গতকাল মঙ্গলবার রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী নদীতে তলিয়ে গেছে তাপসীর ছেলে প্রিয়ন্ত দে (১৫)। এই খবর শোনার পর থেকেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তাপসী। প্রিয়ন্তের সঙ্গে একই ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছে তার মাসতুতো ভাই শাওন দত্ত (১৬)। দুজনই এবার ৯ম থেকে ১০ম শ্রেণিতে ওঠার কথা।
নিখোঁজের ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার পর আজ বুধবারও দুই কিশোরের হদিস মেলেনি। ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কাপ্তাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদ। তিনি বলেন, চন্দ্রঘোনা সীতার ঘাট এলাকায় গোসল করতে নেমে দুই কিশোর নিখোঁজ হয়। উদ্ধার অভিযান চলছে।
নিখোঁজ হওয়া শাওন দত্তের বাসা নগরের দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকায়। ওখান থেকে আধা কিলোমিটার দূরে আলকরণ চক্রবর্তী কলোনিতে থাকে প্রিয়ন্তরা। দুই বাড়িতেই এখন অজানা আশঙ্কায় মাতম চলছে।
চক্রবর্তী কলোনিতে ঢোকার মুখে প্রতিবেশীদের জটলা। সবার চোখেমুখে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা দুই কিশোরের জন্য। একতলার ঘরটিতে ঢুকে দেখা গেল প্রিয়ন্তর মা তাপসী বিছানায় শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ বিলাপ করছেন। কিছুক্ষণ কথা বলছেন স্বজনদের সঙ্গে। আবার আপন মনে কী যেন বলছিলেন।
‘প্রিয়ন্তরা দুই ভাই। গতকাল সকালে প্রিয়ন্ত বের হয়ে যাওয়ার সময় মা তাপসী ঘুমিয়েছিলেন। রাতে কথা হয়েছিল দুজনের। রাতে আমাকে বলেছে সে আর আমার বোনের ছেলে শাওন সীতাকুণ্ড ডিসি পার্ক বেড়াতে যাবে সকালে। কিন্তু তারা নাকি চলে গেছে কাপ্তাই। পরে দুপুরে তার বাবার কাছে ফোন আসে, ছেলে নাকি পানিতে পড়ে গেছে।’
বলতে বলতে আবার মূর্ছা যান তাপসী। ঘরে স্বজনেরা তাঁর হাত–পা মালিশ করে দিচ্ছিলেন। প্রিয়ন্তর পিসি পপি দে বলেন, ‘তারা ৯ বন্ধু মিলে ওখানে গিয়েছে। কারা কারা ওখানে যাচ্ছে, বলেনি। আমরা জানতাম শুধু শাওন ও প্রিয়ন্ত যাচ্ছে। প্রিয়ন্ত তো সাঁতার জানে না। সে পানিতে নামতে যাবে কেন? এটা বুঝতে পারছি না।’
দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রিয়ন্ত বড়। ছোট ভাই নিবিড় দে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। দুজনই ঘরের পাশের নূর আহমদ সিটি করপোরেশন উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র। শাওন দত্তরাও দুই ভাই। শাওন ছোট। বড় ভাই শ্রাবণ দত্ত সিটি কলেজের ছাত্র। রেলওয়ে পাবলিক উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ে শাওন। দুই মাসতুতো ভাই একে অপরের বন্ধু। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে দুজনই বেড়াতে যায় বন্ধুদের সঙ্গে। তবে বাসায় দুজনের কেউ কাপ্তাই বা চন্দ্রঘোনা যাওয়ার কথা বলেনি।
শাওনের মা রূপসী দত্ত ছেলের এমন দুর্ঘটনার খবর শোনার পর থেকে নাওয়া–খাওয়া ছেড়েছেন। সারাক্ষণ সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছেন। ‘আমার ছেলে সাঁতার জানে না। সে কেন পানিতে নামল? আমাকে বলেছে সি বিচে যাবে। সে ওখানে কেন চলে গেল। বন্ধুদের প্ররোচনায় চলে গেছে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। তাই আমিও কিছু বলিনি। সকালে যাওয়ার সময় শুধু বলেছে, মা আমি যাচ্ছি। বিকেলে ফিরব।’ বিলাপ করছিলেন রূপসী দত্ত।
শাওনের শোবার ঘরের এক পাশে পড়ার টেবিলে ৯ম শ্রেণির বইপত্র। স্কুলের ব্যাগ, শার্ট, প্যান্ট ছড়ানো–ছিটানো আছে। ৩০ ডিসেম্বর ফলাফল দেওয়ার কথা। তার আগে ঘুরতে যায় মাসতুতো ভাইসহ। সন্ধ্যার দিকে ফিরবে এমনটা বলেছিলেন বড় ভাই শ্রাবণকেও।
বেলা দুইটার দিকে ফোনে শাওনের এমন দুর্ঘটনার কথা জানতে পারেন মা রূপসী ও বড় ভাই শ্রাবণ। পরে বাবা জিতন দত্তকে জানানো হয়। জিতন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোটখাটো কাজ করেন। ছেলেদের এমন খবর শুনে গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে জিতন দত্ত ও তাঁর ভায়রা বিপ্লব দে রওনা দেন চন্দ্রঘোনার সীতার ঘাট এলাকায়। সঙ্গে যান শ্রাবণ দত্ত।
নিখোঁজ দুই কিশোরের জন্য স্বজনেরা চন্দ্রঘোনা ও চট্টগ্রাম শহরে অপেক্ষা করছেন। যদি অলৌকিক কিছু ঘটে যায়, এমন আশা হয়তো মা-বাবার মনের কোণে। তাপসী দে বলছিলেন, ‘ছেলেকে বেলা ১১টার দিকে ফোন করেছিলাম। তখন সে বলেছে, একটু পর তোমাকে ফোন করছি। আমি ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। ভগবান এমন বিপদ কেন দিল।’